কার্তিকের অমাবস্যার রাতে কালী পূজার্চনার মন্ত্রে থমথম করে চৈতন্যভূমির আকাশ। সুপ্রাচীন এই জনপদ শাক্তপীঠের জন্যও বিখ্যাত।
সময়টা সতেরো শতকের মাঝামাঝি। অধুনা বাংলাদেশের যশোর থেকে নৌকা যোগে চলেছেন তন্ত্রাচার্য ভৃগুরাম। সঙ্গে তিন পুত্র ও পরিবার। নৌকা যখন নবদ্বীপ অতিক্রম করছে, প্রবল ঝড়ে ডুবে গেল তাঁর নৌকা। কোনওক্রমে প্রাণে বাঁচলেন সপরিবার ভৃগুরাম। অস্থায়ী আস্নাতাও বাঁধতে হল তাঁকে নবদ্বীপে। তন্ত্রাচার্য যে এখানে থাকছেন, সে কথা কানে গেল নদিয়া রাজ কৃষ্ণচন্দ্রেরও। শক্তির উপাসক নদিয়া রাজ তখন নিজেই ঘোর পারিবারিক সঙ্কটে। নবাবের নজর পড়েছে তাঁর পরিবারের এক পরমাসুন্দরী কন্যাকে। তিনি সেই কন্যাকে বিবাহও করতে চান। কী করে তাঁকে নিবারণ করবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না কৃষ্ণচন্দ্র। তিনি শরণাপন্ন হলেন ভৃগুরামের।
তন্ত্রাচার্য তাঁকে আশ্বস্ত করলেন। কিন্তু কী ভাবে তিনি মহারাজকে রক্ষা করবেন, সে কথা কিছু ভেঙে বললেন না। কৃষ্ণচন্দ্র অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় দিন কাটাতে লাগলেন। এ দিকে কন্যাকে নিয়ে যাওয়ার দিন এগিয়ে আসছে। হতাশ মহারাজ যখন ভাবছেন কী করবেন, তখনই দেখা গেল কন্যার সর্বাঙ্গে বসন্তের গুটি বেরোচ্ছে। আর সেই দেখে পাণিপ্রার্থী দে ছুট। তারপরেই কুলকন্যা ফিরে পেলেন তাঁর রূপ। অভিভূত মহারাজ ভৃগুরামকে দিলেন অনেক ভূসম্পত্তি। তাঁর তিন পুত্রকে দেওয়া জমি এখনও নবদ্বীপ পুরসভায় তেঘরি মৌজা বলে পরিচিত। |
ভৃগুরাম তেঘরিপাড়ায় পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেন। শুরু করেন কালীপুজো। নবদ্বীপের দক্ষিণ অঞ্চলে তাঁর পঞ্চমুণ্ডীর আসন, যা শ্যামাপীঠ বলে পরিচিত, আজও সেখানে পুজো হয়। ওই পরিবারের পক্ষ থেকে জানা গিয়েছে, পুজো হয় সম্পূর্ণ তান্ত্রিক মতেই।
শহরের আশেপাশে এমনই অনেক শতাব্দী বা তারও বেশি প্রাচীন পুজো রয়েছে। নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণদের হাতে শুরু হয়েছিল সেই সব পুজো। পাড়ার মা, ওলা দেবী, শ্মশান কালী সর্বোপরি আগমেশ্বরী কালী। পাঁচশো থেকে তিনশো বছরের মধ্যে এই সব পুজোর উদ্ভব। জড়িয়ে রয়েছে নানা কাহিনি।
শহরের একেবারে পশ্চিমে মালঞ্চ পাড়ায় অবস্থিত পাড়ার মা-র সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এমনই কাহিনি। নবদ্বীপ সংলগ্ন বাবলারি গ্রামে বহু আগে এক সন্ন্যাসী ঘট স্থাপন করে তন্ত্রসাধনা শুরু করেন। বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, এই সন্ন্যাসীর নাম বৃহদ্রথ। তিনি সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। স্থানের নাম তাই হয় সিদ্ধেশ্বরী তলা। এরপরে গঙ্গার ভাঙনে সিদ্ধেশ্বরী তলা বিপন্ন হয়। সেই সময়ে নবদ্বীপে নব্যন্যায়ের পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম শহরেই টোলে অধ্যাপনা করছেন। বাসুদেব সেই ঘটকে সিদ্ধেশ্বরী তলা থেকে এনে শহরের মধ্যিখানে স্থাপন করেন। তখনই এই দেবীর নাম হয়ে যায় পাড়ার মা। পাড়ায় এসেন তাই পাড়ার মা। এই ঘটনার সময়ে আনুমানিক ১৬শো খ্রিস্টাব্দ হলেও এই বাসুদেব কিন্তু চৈতন্যের সমসাময়িক বাসুদেব সার্বভৌম নন। তিনি অন্য এক নৈয়ায়িক পণ্ডিত বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞেরা। আজও গভীর রাতে পুজো হয় সেই দেবীর। পাড়ার মা’র পুজো শুরু না হলে আগমবাগীশের প্রতিষ্ঠিত কালীর পুজোও আজও শুরু হয় না।
নদিয়ার আর এক প্রান্ত শান্তিপুরের শ্যামাপুজোর ইতিহাসও কয়েক শতাব্দী প্রাচীন। এখানে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের প্রপৌত্র রত্নগর্ভ সার্বভৌম প্রতিষ্ঠিত কালীপুজো সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। প্রাচীন বুড়ি মা, মহিষখাগীর পুজো, জজ পণ্ডিতের বাড়ির পুজোও।
তবে পণ্ডিতদের কালীপুজোর পাশাপাশি ডাকাতদের পূজ্য কালীরও প্রতিষ্ঠা যথেষ্ট। ডাকাতে কালী, চর জিজিরার কালী, কাঁসারি পাড়ার কালী, বাংলা ইস্কুলের কালী, কালী মুখোপাধ্যায়ের মাঠের কালীএ সবই কোনও না কোনও ডাকাতের হাত ধরে শুরু বলে মনে করেন গবেষকেরা। শান্তিপুরের বিধায়ক অজয় দে বলেন, “শ্যাম ও শ্যামার মিলিত আরাধনার পীঠস্থান শান্তিপুর। আমাদের পারিবারিক দেবী বুড়ি মা সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো। পারিবারিক মন্দিরে প্রতি অমাবস্যায় পাটপুজো হয়। বলা হয় আমাদের বাড়ির কালী বুড়ি মা সাজতে আসেন, আর চাদুনী বাড়িতে ভোগ খেতে আসেন।” অজয়বাবু বলেন, “শহরের প্রধান দুই দেবী আগমেশ্বরী ও মহিষখাগীকে নিয়েও কাহিনি রয়েছে। বলা হয় এই দুই দেবী দুই বোন। কিন্তু সামনাসামনি দেখা হলে বিপদ অনিবার্য। তাই মহিষখাগী দিনে বের হয়। আগমেশ্বরী বার হয় রাতে।” শান্তিপুরের শিক্ষক অকৈতব মৈত্র বলেন, “সে কালে এই এলাকায় ডাকাতদের বসবাস ছিল। ডাকাতেরা শক্তির উপাসকও।” |