সার্বিক টিম থিম থাকে ভারতীয় ক্রিকেট দলের। প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ সিরিজেই! এ বারেরটা কী, এখনও কোথাও বার হয়নি।
মঙ্গলবারের আমদাবাদ খানিক আভাস দিয়ে গেল। দীপাবলির রাতে ধোনিদের সিরিজের নতুন টিম থিম মনে হল, স্বেচ্ছায় নিকষ অন্ধকারের বাণপ্রস্থ আবাহনে মাধ্যমে আলোর উৎসবে ফেরার গভীর অঙ্গীকার!
ভারতের আর-পাঁচটা শহরের দেওয়ালি রাতের ছবি-টবি যদি নিউজ চ্যানেলগুলোয় দেখে থাকেন, আমদাবাদ মোটামুটি একই রকম। শুধু নরেন্দ্র মোদীর জমানায় রাস্তা-টাস্তাগুলো ঝকঝকে। সাজানো গোছানো। মধ্যিখানের বুলেভার্ড জুড়ে অন্তত টানা এক মাইল রাস্তায় গুজরাতের পৃথিবী-বিখ্যাত ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডরের ছবি। নতুন আমদাবাদ ছাড়িয়ে গাড়ি যত পুরনো শহরের দিকে ছুটবে, ততই দীপাবলির দাপট বাড়বে। বাজি পুড়ছে, রকেট উড়ছে, বাড়িতে বাড়িতে রঙ্গোলি। লাড্ডু আর মিঠাই প্যাকেট-প্যাকেট উড়ে যাচ্ছে। জলপ্রপাতের মতোই আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে শহরের গা বেয়ে। টিম হোটেলের আশেপাশে তো যত রাত বাড়ছে তত বাজির আওয়াজ। উৎসব থেকে কোনও ভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার উপায় নেই। হয় আলো। না হয় শব্দ। নয়তো গন্ধ। কোনও একটা কিছু আপনাকে আক্রমণ করবেই।
আর সেই আলোকোজ্জ্বল বৃত্তের মধ্যে যেন একটা অন্ধকারের বৃত্ত স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিজেদের জন্য তৈরি রেখেছিল টিম ইন্ডিয়া। শহর আমদাবাদ আর আমদাবাদে থাকা ভারতীয় দলএই দুইতে তাই অদ্ভুত বৈপরীত্য। একটা যত উজ্জ্বল হয়ে উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা। আর একটা ততই উৎসবের মধ্যে সামনে পরীক্ষা থাকা স্টুডেন্টের মতো নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে পড়ছে। |
বিশাল মোতেরায় অঙ্গীকারবদ্ধ সচিনের সেই অনন্ত দৌড়। |
শ্বেতাঙ্গ দেশগুলোর ২৫ ডিসেম্বর। পাকিস্তানিদের ঈদ। ভারতীয়দের দীপাবলি আর হোলি। ক্রিকেট দুনিয়ায় এগুলো যার-যার উৎসবের দিন বলে স্বীকৃত। এ সময় টিমের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সংখ্যা বেড়ে যায়। অনুশীলনে অনেক ছাড় পাওয়া যায়। এমনকী অস্ট্রেলিয়ার মতো ডাকাবুকো শৃঙ্খলাপরায়ণ টিমেও বাচ্চারা অনুশীলনে আসে-টাসে। বড়দিন, তাই হালকা ট্রেনিং করে দলকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অনেক সময় ট্রেনিং হয়ও না।
ধোনি-বাহিনীতে সে সব ছুটকারার চিহ্নমাত্র দেখা গেল না। ক্যাপ্টেনের স্ত্রী রয়েছেন। আরও দু’তিন জনেরও। কিন্তু অতীতে যেমন দলবল নিয়ে ধোনিকে বাজি-টাজি পোড়াতে দেখেছি, এ বার সেই কাহিনি নেই। দলের এক মুখপাত্র বললেন, “খুচখাচ কেউ কিছু পোড়াবে কি না, সে তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে সাধারণ ভাবে এ বার আমাদের সিদ্ধান্ত শান্ত দীপাবলি উদযাপনের।” টিমের মেজাজ জেনেই বোধহয় বউ-বাচ্চাদের কেউ আনায়নি।
গত বছরের ইংল্যান্ড সফর থেকেই টেস্টের আগের আগের দিন সিনেমা দেখার একটা রেওয়াজ চালু হয়েছে দলে। সাপোর্ট স্টাফের মুখে শুনলাম, ধোনিরা সাত-আটজন মিলে ‘যব তক হ্যায় জান’ দেখতে গিয়েছেন। লক্ষ্য সিনেমা দেখা এবং একসঙ্গে খাওয়ার মাধ্যমে টিম বন্ডিং।
তিনিসচিন তেন্ডুলকর কি সেই দলে ছিলেন? যত দূর শুনলাম, না। দেওয়ালিতে বেশ কয়েক বার পরিবার তাঁর সঙ্গে থেকেছে। আর কঠিন সময়ে-টময়ে যখন বাড়তি মনঃসংযোগের জন্য তাদের সঙ্গে আনেননি, ছেলে অর্জুন শাসানি দিয়ে বলেছে, পৃথিবীর সমস্ত ক্রিকেট স্টেডিয়াম সে তালাচাবি দিয়ে বন্ধ করে দেবে!এই অর্জুন সেই শাসানি দেওয়ার বয়সে নেই। নিজেই এখন খেলছে। সচিন কিন্তু তাঁর পুরনো বয়সেই আছেন! তেইশ বছর আগে যেমন ছিলেন! দুপুরে মোতেরার বাইরে দীর্ঘক্ষণ ব্যাট করে আসার পর মূল মাঠটায় ঢুকে কয়েক পাক আড়াআড়ি দৌড়লেন। অত বড় মাঠে তখন ভারতের আর কেউ নেই। যারা জল-টল দেয় তারাও না। একা অত বড় স্টেডিয়ামে তেন্ডুলকর যেন অনন্তের সঙ্গে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে কাটালেন। হে ক্রিকেট-ঈশ্বর, তোমার অধ্যয়নে আমি অক্লান্ত। এ বার আমার সাংঘাতিক সঙ্কটের সময়ে আমার দিকে এক বার মুখ তুলে চাও...চাও!
|
মঙ্গলবার শহর আমদাবাদ যখন দেওয়ালির রোশনাইয়ে। |
পুরনো আমদাবাদের দিকে যেতে হলে বিশাল নেহরু ব্রিজ পড়বে। যার দু’দিকে আলো দিয়ে এত সুন্দর সাজানো যে, তার তলাতেই চেয়ার পেতে রাতভর তিন পাত্তি শুরু করে দেওয়া যায়। অথচ গোটা আমদাবাদ যদি সেই নেহরু ব্রিজের ওপরকার আলো হয়, সচিন যেন ব্রিজের নীচের সবরমতী নদী। সম্পূর্ণ অন্ধকার।
চূড়ান্ত এগারোয় কে থাকবে না থাকবে। ভারত তিন স্পিনার খেলাবে কি না। এ সব ভাবনার স্বাভাবিক দিন মঙ্গলবার ছিল না। পশ্চিম আমদাবাদস্থিত ফোর্টইয়ার্ড ম্যারিয়টে ছুটকো এ সব আগ্রহকে ছাপিয়ে উঠে এল টিম দর্শন।
পরিষ্কার বোঝা গেল ভারতীয়রা লজ্জার অন্ধকার ইতিহাসকে উদগ্র ভাবে পাল্টে দিতে চাইছে আলোর সরণিতে। তার জন্য যা যা আত্মত্যাগ দরকার, করবে। মনে রাখতে হবে শুধু তো আলোয় ফেরা নয়। ০-৪ হারের প্রতিহিংসা নেওয়াও রয়েছে। তার জন্য সংযম আরও গভীর হতেই হবে।
ক্রিকেট ইতিহাস বিচারে এ বারের সিরিজ তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত-ইংল্যান্ড ক্রিকেট প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশি বছর পূর্ণ হল এ বার। ১৯৩২-এর ২৫ জুন থেকে ২০১২ আমদাবাদের সম্ভাব্য ১৫ নভেম্বরের সকাল। অথচ দেশি-বিদেশি কোনও মিডিয়াতেই যে আশি বছর ব্যাপারটা গুরুত্ব পায়নি, এটা খুব আশ্চর্য। |
দুই শিবিরের দুই অস্ত্র |
|
|
ধোনির ক্লাসে কোহলি। ‘গারদ’ থেকে বেরিয়ে পিটারসেন।
মঙ্গলবার আমদাবাদে। |
|
তেমনই আশ্চর্য লাগল কেভিন পিটারসেনকে এত হাসিখুশি দেখে। সচিন এবং টিম ইন্ডিয়ার মতো পিটারসেনেরও তো নিকষ ঘন অন্ধকারের বাণপ্রস্থ আবাহন করা উচিত ছিল। এত বিতর্কের পর তিনি দলে ফিরেছেন। মাঠে কী রান করেন, তার চেয়েও বেশি করে সবাই তাকিয়ে রয়েছে, ইংল্যান্ড ড্রেসিংরুমে কী ভাবে মানিয়ে নেন। পিটারসেন উল্টে যেন দীপাবলির মুডে। দুই ইংরেজ সাংবাদিক হোটেল লাউঞ্জে তাঁকে দেখতে পাননি। তাঁদের শিস দিয়ে ডাকলেন। ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডে ছবি বার হওয়ার মতো! গত ক’মাস এই সাংবাদিকদের সঙ্গেই তো তাঁর সবচেয়ে বেশি লেগেছে। উত্তপ্ত হয়ে এঁদের কাউকে একটা সাক্ষাৎকার পর্যন্ত দেননি। আজ এঁদেরই কিনা ডেকে কথা বলছেন!
পি-আর অনুশীলন? এখনই জানার উপায় নেই। আর একটা কারণ হতে পারে প্রবাদপ্রতিম ক্রিকেটারের তাঁকে দেওয়া টিপস। যা আঁকড়ে পিটারসেন প্রচণ্ড উপকারও এক সময় পেয়েছিলেন।
কেভিন, সঙ্কটে মনটাকে পরিষ্কার আর জল দিয়ে ধোওয়ার মতো ধুয়ে রাখবে। জটিল হতে দিও না। যত সহজ-সিম্পল রাখবে, ব্যাটিংটাও তত সহজে বইবে।
পরামর্শদাতার নাম? সচিন তেন্ডুলকর!
|