আর্থিক সংস্কার কি নির্বাচনী সাফল্যের শত্রু? গত দুই দশকে ভারতীয় রাজনীতিতে এই প্রশ্ন বারংবার উত্থাপিত হইয়াছে। আশির দশক হইতে সংস্কারের দরজা খুলিতে শুরু করিলেও উদার অর্থনীতির যথার্থ অভ্যুত্থান ঘটে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায়। তাহার পর আর্থিক নীতির গতিপথ মসৃণ থাকে নাই বটে, কিন্তু ভারত আর পুরানো রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ঘেরাটোপে ফিরিয়াও যায় নাই। সংস্কারের স্রোতে জোয়ারভাটা আসিয়াছে, কিন্তু স্রোত স্তব্ধ হয় নাই। এই জোয়ারভাটার চরিত্র বিশ্লেষণেই অনেক সময় নির্বাচনী রাজনীতিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছে। যেমন, প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও যখন তাঁহার মধ্যপথে অর্থনীতির ‘মধ্যপন্থা’র গুণগানে মুখর হইয়া ওঠেন, তখন বলা হইয়াছিল, ভোট আসিতেছে, তাই এখন সংস্কারের মন্ত্র অচল। কিংবা, অন্য দিকে, অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন সংস্কার-চালিত ‘ভারত উদয়’-এর জয়গান গাহিয়া ভোটে হারেন, তখন সিদ্ধান্ত হইয়াছিল, সংস্কার দিয়া ভোটে হারা যায়, জয়লাভ অসম্ভব। কেবল কেন্দ্রীয় স্তরে নয়, রাজ্য স্তরের নির্বাচনেও একই তত্ত্ব বহুলপ্রচলিত। অন্ধ্রপ্রদেশে চন্দ্রবাবু নায়ডুর পরাজয় এই তত্ত্বের প্রমাণ হিসাবেই পরিচিত। স্বভাবতই, ইউ পি এ’র দ্বিতীয় দফা যখন অন্তিম পর্বে পৌঁছাইতেছে, তখনও একই তত্ত্বের গুঞ্জন বাড়িতেছে। বলা হইতেছে, কংগ্রেসের ভাঙা কপাল জুড়িতে হইলে এখন সংস্কারের ধ্বজা গুটাইয়া রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হইবে, এ বার জনকল্যাণে বিপুল ব্যয় এবং বিপুলতর প্রচারের প্রয়োজন। এই অভিমতটি, বরাবরের মতোই, কংগ্রেসের অন্দরমহলে বিশেষ ভাবে প্রবল। কংগ্রেসের একটি অংশ নরসিংহ রাওয়ের জমানাতেও সংস্কারের প্রতি বিমুখ ছিল, প্রধানত নির্বাচনী স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হইবার ভয়েই। আজও সেই বিরূপ হাওয়া থামিয়া যায় নাই।
আশার কথা একটিই। কংগ্রেসের নায়ক এবং চালকরা এই প্রতিকূল হাওয়ায় আপন গতি স্তব্ধ করিয়া সংস্কারের ঝাঁপ ফেলিয়া দিবেন, এমন লক্ষণ এখনও দেখা যাইতেছে না। বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদায়ের পর হইতে তাঁহাদের অবরুদ্ধ তরণী নূতন করিয়া চলিতে শুরু করিয়াছে, এবং আরও কিছুটা চলিবার লক্ষণ দেখা যাইতেছে। তাহার অর্থ ইহা নহে যে, নির্বাচনের ভীতি সম্পূর্ণ অপসারিত। তাহার অর্থ ইহাও নহে যে, এই সরকার তাহার অবশিষ্ট দিনগুলিতে আর্থিক সংস্কারেই মনপ্রাণ সমর্থন করিবে। কিন্তু অন্তত এইটুকু আশা করিবার কারণ আছে যে, জনসমর্থন আদায়ের তাড়নায় উদার অর্থনীতির প্রকল্পগুলিকে বিসর্জন দেওয়া হইবে না। সংস্কার এবং জনকল্যাণ যে একই সঙ্গে সম্ভবপর, তাহা প্রমাণ করিবার এবং জনসাধারণকে বুঝাইবার একটি উদ্যোগ করা হইবে।
এই উদ্যোগ একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় এবং সম্ভব। প্রয়োজনীয়, কারণ সংস্কার ব্যতিরেকে প্রকৃত দীর্ঘমেয়াদি জনকল্যাণ ঘটিতে পারে না। প্রথমত, আয়বৃদ্ধি জনকল্যাণের আবশ্যিক শর্ত এবং বৃদ্ধির জন্য সংস্কার জরুরি। দ্বিতীয়ত, সংস্কার না হইলে আয়বৃদ্ধির সুফল দরিদ্র মানুষের নিকট পৌঁছাইবার পথটিও যথেষ্ট প্রশস্ত ও মসৃণ হইবে না। সুতরাং, উভয়তই, দরিদ্রের স্বার্থেই সংস্কার জরুরি। দ্বিতীয়ত, এমন কথা মনে করিবার কিছুমাত্র কারণ নাই যে, সংস্কারের এই কল্যাণী মূর্তিটি জনসাধারণকে দেখাইলে তাঁহারা দেখিতে পাইবেন না। বিশেষজ্ঞরা গত দুই দশকের নির্বাচনী ফলাফল এবং তাহার রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণ করিয়া দেখাইয়াছেন, সংস্কারের পথে হাঁটিয়া কেন্দ্রে ও রাজ্যে যে সরকার হারিয়াছে, তাহারা সংস্কারের পথে হাঁটিবার কারণেই হারিয়াছে, এমন কোনও প্রমাণ নাই, পরাজয়ের অন্য সঙ্গত কারণও ছিল। সংস্কারবিরোধী মনোভাবের বশে সেই কারণগুলিকে অগ্রাহ্য করিলে কেবল খণ্ডদর্শনই হয় না, ভ্রান্তদর্শনও হয়। পাশাপাশি, সংস্কার করিয়াও ভোটে সফল হইয়াছে, এমন সরকারের দৃষ্টান্তও রহিয়াছে, যথা নীতীশ কুমারের বিহার অথবা প্রথম ইউ পি এ’র ভারত। নির্বাচনী সাফল্য ও ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান অনেক বৃহৎ এবং জটিল প্রকল্প। সংস্কারের একমাত্রিক কারণ দিয়া তাহার ব্যাখ্যা না করাই শ্রেয়। সংস্কার স্বতঃই জরুরি। মনমোহন সিংহ তাহা জানেন। সনিয়া গাঁধী যদি এই সত্য উপলব্ধি করিয়া থাকেন, ভারতের মঙ্গল। |