ভোরের ভয়
হার-দুল খুলেছেন? এ বার হাঁটতে চলুন
সোনার দুল, হার তো বটেই, মায় মোবাইল ফোনটাও বাড়িতে রেখে প্রাতর্ভ্রমণে বেরোন মধ্যবয়সী মধুছন্দা দাশগুপ্ত! সকালের ফাঁকা রাস্তায় ওগুলো সঙ্গে থাকলে কোনও মতেই নিরাপদ বোধ করেন না তিনি।
মোটরবাইকের আওয়াজ শুনলেই ঘোমটা টেনে তাড়াতাড়ি কান আর গলা ঢেকে নেন প্রৌঢ়া দীপা মজুমদার! সকালের ফাঁকা রাস্তায় ওই আওয়াজটা তাঁর কাছে কার্যত ‘বিপদ-সঙ্কেত’। কানের একটু ঝোলানো দুলটা এই বুঝি হ্যাঁচকা টানে ছিনিয়ে নিল কেউ!
হাইজাম্প-লংজাম্প প্র্যাকটিসে বেরোনোর আগে সাধের সোনার গয়না বাড়িতে খুলে আসেন বীথিকা দে, অদিতি পালরাও। সকালের শহরে ওগুলো পরে বেরোতে ভরসা পান না ওই দুই তরুণী অ্যাথলিট।
মোটরবাইকে চেপে ছিনতাইয়ের একের পর এক ঘটনা ঘটছে শহরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিশানায় প্রাতর্ভ্রমণকারী মহিলারা। প্রায় কোনও ঘটনাতেই দুষ্কৃতীদের ধরতে পারেনি পুলিশ। প্রাতর্ভ্রমণ সেরে বাড়ি ফেরার সময়ে নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তাই নিজেরাই নিয়েছেন মধুছন্দা, দীপা, বীথিকা, অদিতিরা। যখন-তখন হানার ভয়ে ওঁরা সন্ত্রস্ত। শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ চিত্রটা একই।
ছিনতাইবাজের হ্যাঁচকা টানে গায়ের গয়না খোয়া যেতে পারে যে কোনও সময়ে।
শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্রই তাই সতর্ক মহিলারা। প্রায় নিরাভরণ হয়েই
প্রাতর্ভ্রমণে বেরোচ্ছেন তাঁরা। উত্তর কলকাতার দেশবন্ধু পার্ক। ছবি: সুমন বল্লভ।
মঙ্গলবার সকালে অন্ধকার কেটে আকাশ সবে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। গল্ফগ্রিনে দূরদর্শন কেন্দ্রের উল্টো দিকের রাস্তায় প্রাতর্ভ্রমণ করছিলেন গল্ফ গার্ডেনের মধুছন্দাদেবী। জানালেন, রাতেই গয়নাগাঁটি খুলে রাখেন। সকালে হেঁটে বাড়ি ফিরে আবার সে সব পরে নেন। বলেন, “আগে মোবাইলটা নিয়ে বেরোতাম। টেলিফোন করার অজুহাতে এক দিন দুই যুবক আমার কাছে মোবাইলটা চেয়েছিল। বুঝেছিলাম, ওদের উদ্দেশ্য ভাল নয়। সে দিন কোনও রকমে বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু তার পর থেকে ফোনটাও আর সঙ্গে রাখি না।”
মধুছন্দাদেবীর আশঙ্কারই প্রতিফলন শ্যামবাজারের দেশবন্ধু পার্কে প্র্যাকটিসে আসা অ্যাথলিট বীথিকা ও অদিতির গলায়। দু’জনেই জানালেন, প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে ছিনতাইয়ের খবর পড়ে তাঁরা আতঙ্কিত। বলেন, “এখন তো দেখছি কোথাও মহিলাদের গুলি করে দিচ্ছে, কোথাও মেরে মুখ ফাটিয়ে দিচ্ছে। ভয়ের চোটে সোনার কোনও গয়না পরতে পারছি না। এমনকী, মোবাইলটাও ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখি। যাতে ওটার জন্য ছিনতাইকারীদের পাল্লায় পড়তে না হয়।”
গল্ফগ্রিনের কাছে অরবিন্দ নগরের বাসিন্দা গীতা সেনগুপ্ত ও দীপাদেবীর বাড়ির লোক নিত্য ছিনতাইয়ের খবরে এতটাই আতঙ্কিত যে, ওঁদের হাঁটতে বেরোতেই বারণ করেন। দেখা গেল, গায়ে নামমাত্র গয়না পরে কান-মাথা-গলায় ভাল করে শাল জড়িয়ে হাঁটছেন দুই প্রৌঢ়া। শীত বলেই নয়, অন্য সময়েও হাঁটতে হাঁটতে ঘোমটায় কান-গলা মুড়ে নেন ওঁরা। দীপাদেবীর কথায়, “আমার দুলটা একটু ঝোলানো। হ্যাঁচকা টানে ছিনিয়ে নেওয়া যায়। সকালে মোটরবাইকের আওয়াজ পেলেই ভাল করে ঘোমটা দিয়ে নিই।” ওঁদের অভিযোগ, রাস্তায় পুলিশের দেখা মেলে না বললেই চলে।
উত্তর কলকাতা বনাম দক্ষিণ কলকাতা দ্বৈরথ শহরবাসীর আলোচনার অন্যতম প্রিয় বিষয়। কিন্তু দুষ্কৃতীদের হানায় কার্যত বিপর্যস্ত শহরের দুই প্রান্তের প্রাতর্ভ্রমণকারীদের আশঙ্কায় একটা যোগসূত্র তৈরি হয়েছে উত্তর ও দক্ষিণের বাসিন্দাদের মধ্যে।
দেশবন্ধু পার্কের কাছেই বাড়ি মধ্যবয়সী শিবানী চন্দের। ডায়াবেটিসের রোগী শিবানীদেবী নিয়মিত পার্কে যান হাঁটতে। বলেন, “পার্কে এক বার ঢুকে গেলে ঠিক আছে। অনেক লোক। কিন্তু বাইরের রাস্তাটা নির্জন। বিকেলের পরে আরও নিঝুম হয়ে যায়। বিকেলে বেরোনোর ঝুঁকি আর নিই না।”
গল্ফগ্রিনের সেন্ট্রাল পার্কে হাঁটতে যান রমা দে। বাড়ি থেকে কিছুটা হেঁটে পার্কে পৌঁছতে হয়। ওঁরও ডায়াবেটিস। বলেন, “পার্কে ভয় নেই। অনেক মানুষ, পুলিশেরও দেখা মেলে। কিন্তু ডাক্তার আমাকে সোজা রাস্তায় হাঁটতে বলেছেন। পার্কটা গোল। তাই বাড়ি থেকে যে রাস্তা ধরে হেঁটে পার্কে আসি, সেখানে হাঁটাই বেশি দরকার। ওই রাস্তায় পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা হলে অনেক নিরাপদ বোধ করব।”
দক্ষিণ কলকাতার গল্ফ গ্রিন। মঙ্গলবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
নানা রকম রোগের হানায় কাহিল প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থেকে ‘স্লিম’ হওয়ার নেশায় বুঁদ তরুণ-তরুণী প্রাতর্ভ্রমণকারীর দলে আছেন সকলেই। এঁরা সকলেই পায়ে স্নিকার পরে হনহনিয়ে হেঁটে বেড়ান না। অনেকে সংসারে ঢুকে পড়ার আগে সকালের নরম রোদ গায়ে মেখে, দিব্যি গল্প করে কিছুটা সময় কাটান। দেশবন্ধু পার্কে যেমন সঙ্গীতা ঘোষ, স্মৃতি দাস, শোভা ঘোষ, রীতা সাহা, রাণু চট্টোপাধ্যায়, ঢাকুরিয়া লেকে তেমনই ছবি চট্টোপাধ্যায়, মালা দে, বুলা সাউ, কৃষ্ণা ঘোষ। সকলেই পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েছেন। সোনার গয়না দূর অস্ত্, ওঁরা নকল সোনা পরে বেরোতেও ভয় পাচ্ছেন। শুধু খবরের কাগজে নয়, দুই দলের সদস্যেরাই ছিনতাইয়ের গল্প শুনেছেন নিজেদের কানে। কেউ বা চোখেও দেখেছেন।
দেশবন্ধু পার্কের দলটি জানাল, তাদের এক সদস্যের সোনার চেন কিছু দিন আগেই ছিনতাই হয়েছে। অন্য এক জনের দুল ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তাঁর গালে থাপ্পড় মেরে রাস্তায় ফেলেও দিয়েছিল মোটরবাইকে চড়া দুই ছিনতাইবাজ। আর লেকের দলটির সদস্যেরা জানালেন, এক জনের সোনার চেন ছিনিয়ে রেলিং টপকে পালাতে দেখেছেন দুষ্কৃতীদের। দেখতে পায়নি শুধু পুলিশ। কারণ, যেখানে প্রাতর্ভ্রমণকারীরাই পরপর ছিনতাইয়ের কবলে পড়ছেন, সেখানে প্রাতর্ভ্রমণের চেনা জায়গাগুলোতেও উর্দিধারী পুলিশের দেখা মেলা ভার!
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.