শ্মশানে নাচিছে শ্যামা...
এক শ্মশান থেকে অন্য শ্মশান। এক আঁধার থেকে অন্য আঁধার। যেখানে গিয়ে জীবনের চলা শেষ হয়, রাতভর সেখানেই ঘোর লাগিয়ে গেল শ্যামার নাচন।
জামুড়িয়ার ইকড়া শ্মশানে ১৩৫ বছর আগে কালীপুজো শুরু করেছিলেন হরিনাথ কাঞ্জিলাল নামে এক সাধক। এই শ্মশানকালী মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সাধক বামাক্ষ্যাপার স্মৃতি। জনশ্রুতি, এক বার বামাক্ষ্যাপা অন্ডাল থেকে ট্রেনে চেপে বৈদ্যনাথধামে যাচ্ছিলেন। টিকিট না থাকায় ইকড়ার কাছে তাঁকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। মনোকষ্টে সাধক হেঁটে চলে যান ইকড়ার শ্মশানে। ও দিকে, ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ট্রেনের গার্ড সাধককে চিনতেন। তিনি টিকিট পরীক্ষককে জানান, সাধককে ডেকে না আনলে ট্রেন চলবে না। গার্ড ও টিকিট পরীক্ষক গিয়ে ক্ষমা চেয়ে সাধককে ফেরানোর পরে ট্রেন চলতে শুরু করে। গ্রামের প্রবীণ স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, ওই ঘটনার বছর দশেক পরে কোনও কারণে এলাকার ব্রাহ্মণেরা অদূরে আলাদা পুজো শুরু করেন। দু’টি পুজোর ক্ষেত্রেই কোনও মূর্তি নেই। চল্লিশ বছর আগে এই শ্মশানে অজিত বাউরি নামে এক ব্যক্তি পৃথক উদ্যোগে মূর্তি পুজো শুরু করেন। সেটি অবশ্য পারিবারিক পুজো বলেই পরিচিত। সেখানে শ্যামাকালীর পুজো হয়। |
১২০২ বঙ্গাব্দে রানিগঞ্জের শ্মশানে পুজো শুরু করেন অন্ডালের বক্তারনগরের তারাচরণ চট্টোপাধ্যায়। কথিত রয়েছে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে জঙ্গলাকীর্ণ এই এলাকা ছিল গোপন শলা-পরামর্শের জায়গা। পরিবার সূত্রে এই মন্দিরের সেবায়েতের দায়িত্ব পেয়েছিলেন বৈদ্যনাথ চট্টোপাধ্যায়। ‘তরুণ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন তিনি, যার অন্যতম পরামর্শদাতা ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বৃটিশ সরকার সেই পত্রিকা বন্ধ করে দেয়। এখন আর সেখানে শ্মশান নেই, পুজো হয় রানিগঞ্জের বড়বাজারে। তবে তা শ্মশানকালী নামেই পরিচিত। মহালয়ার পরে মূর্তি তৈরি শুরু হয়। কালীপুজোর আগের দিন পর্যন্ত ঘট ও পটে পুজো হয়। বর্তমান সেবায়েত অসিত চট্টোপাধ্যায় জানান, শুধু পুজো নয়, প্রতি অমাবস্যাতেও ভক্তের ঢল নামে। নজরুল যে টুলে বসে লিখতেন, সেটি এখানে সংরক্ষিত রয়েছে।
অন্ডালের খান্দরা শ্মশান কালীপুজো শতাব্দী প্রাচীন। তবে রীতিমতো ধুমধাম করে পুজো হচ্ছে আট বছর ধরে। স্থানীয় পঞ্চায়েতের উপপ্রধান বাপি বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, এই পুজো এখন সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। খিচুড়ি ভোগ খেতে আসেন বহু মানুষ। অন্ডালের শ্রীরামপুরের শ্মশানে বছর কুড়ি আগে পুজো শুরু করেন প্রয়াত ভোলানাথ বাগদি। শ্মশানে পুজো করা জরুরি বলেই এই পুজোর আয়োজন, জানালেন এক কর্মকর্তা।
জামুড়িয়ার বোগড়াচটি শ্মশানকালীর পুজো হয় ২ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশেই। পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা সুকুমার বাউরি জানান, সারা বছর পুজো হয়। তবে কালীপুজোর দিন জাঁকজমকের সঙ্গে পুজো হয়। থাকে পাত পেড়ে খাওয়ার ব্যবস্থাও। আসানসোল পুরসভা নিয়ন্ত্রিত দোমহানি শ্মশানকালীর শ্যামারূপ। ১৯২৪ সালে শুরু হয় পুজো। পুজোর দিন পুরনো মূর্তি মন্দির থেকে বের করে এনে রাখা হয় গাছের তলায়। নতুন মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠার পরে পুরনো মূর্তির বিসর্জন হয়। পুজো শুরুর আগে থেকে ভোগ খাওয়ানো শুরু হয়। চলে সারা রাত। শ্মশানের পুরকর্মী বাপি মুখোপাধ্যায় জানান, এই পুজো এলাকায় সর্বজনীন পুজো হয়ে উঠেছে।
বারাবনির নাকটি কন্যাপুর শ্মশান কনৌজ ব্রাহ্মণদের জন্য সংরক্ষিত অন্য কোনও সম্প্রদায়ের দেহ সেখানে দাহ হয় না। ২০০৫ সালে সেখানে পুজো শুরু হয়। আয়োজক সংস্থার তরফে বিকাশ মিশ্র জানান, বহু প্রাচীন এই শ্মশান ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। পুজো শুরুর চাহিদা বাড়ছিল। প্রয়াত বিধায়ক মানিক উপাধ্যায়ের সহযোগিতায় রাস্তা তৈরি হয়। পুজোর পর দিন বিসর্জন হয়। তার পরে আবার কাঠামো তুলে এনে বেদীতে রাখা হয়। সারা বছর সেখানেই হয় নিত্যপুজো।
বারাবনির নুনি শ্মশানকালীর পুজো রীতিমতো জনপ্রিয়। প্রধান কর্মকর্তা রণজিৎ চট্টোপাধ্যায় জানান, প্রাচীন এই শ্মশানে তালপাতার ছাউনিতে পুজো হত। এক বার বৃষ্টিতে সে সব ধুয়ে যায়। তাঁর দাবি, এর পরে দেওঘরে গিয়ে তিনি স্বপ্নে মন্দির গড়ে পুজো করার আদেশ পান। স্থানীয় বাসিন্দাদের ১৯৭৫ সালে মন্দির গড়ে পুজো শুরু হয়। এর পরে প্রয়াত শিল্পপতি সিদ্ধেশ্বর উপাধ্যায় শিলামূর্তি এনে দেন। সারা বছরই অমাবস্যায় ঢল নামে শ্মশানে।
উখড়ায় জমিদার পরিবারের শ্মশানে স্থানীয় বাসিন্দারাই পুজোর আয়োজন করেন। এখানে রক্ষাকালীর পুজো হয়। পুজোর দিনই মূর্তি তৈরি হয়। পুজোর পরে বিসর্জন। অদূরে অবিচল শ্মশানে সারা বছর পুজো হয়। কালীপুজোর দিন মূর্তি আসে। পুজোর পরেই বিসর্জন হয়। অন্ডালের মধুপুর শ্মশানের পুজোও শতবর্ষ প্রাচীন। হিরাপুরের দামোদর শ্মশানে পুজোর দিন জড়ো হন কয়েক হাজার মানুষ। |