রানওয়েতে নামার মুহূর্তে বিমানের উচ্চতা এবং দূরত্বের ভুলচুক হলে কী ঘটতে পারে তা ম্যাঙ্গালোর বিমান-দুর্ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে। দু’বছর আগে সেখানে মৃত্যু হয়েছিল ১৫৬ জনের। তারও আগে পটনা বিমানবন্দরে নামার সময়ে একই ভুলের খেসারত দিতে হয়েছিল এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলটকে। সে বারও পাইলট-সহ মৃত্যু হয়েছিল যাত্রীদের।
দু’টি ক্ষেত্রেই তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট জানিয়েছিল, যন্ত্র নয়, প্রধানত পাইলটদের হিসেবের ভুলে ওই মর্মান্তিক পরিণতি। রানওয়ে ছোঁওয়ার আগে বিমানের উচ্চতা, দূরত্ব (রানওয়ে থেকে বিমানের) ঠিক রয়েছে কি না, তা জানিয়ে দেয় ‘প্রিসিশন অ্যাপ্রোচ পাথ ইন্ডিকেটর’ (পাপি) নামে একটি যন্ত্র। যন্ত্রটি প্রতিটি রানওয়ের দুই প্রান্তে বসানো থাকে। অভিযোগ উঠেছে, কলকাতার দ্বিতীয় রানওয়ের দক্ষিণ প্রান্তের ‘পাপি’ নিয়ম করে ভুল বার্তা পাঠিয়ে যাচ্ছে পাইলটদের!
বেশির ভাগ অভিযোগ মৌখিক হলেও গত ২০ দিনে পাইলটদের প্রায় দশটি লিখিত অভিযোগও জমা পড়েছে। বিমানবন্দর সূত্রে খবর, ‘পাপি’-র ভুল বার্তার ফলে এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি বিমান (উচ্চতা ও দূরত্ব ঠিক থাকলেও) মুখ ঘুরিয়ে আকাশে উড়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় বার নামার সময়েও দেখা গিয়েছে ‘পাপি’ জানাচ্ছে, উচ্চতা ও দূরত্ব ভুল রয়েছে। |
পৃথিবীর যে কোনও বিমানবন্দরের রানওয়ে ছোঁওয়ার সময় ‘পাপি’-র বার্তা-কে অনেকটা ‘বাইবেল’-এর মতোই গণ্য করেন পাইলটরা। বিমানের উচ্চতা ও দূরত্ব ঠিক থাকলে ‘পাপি’-র চারটি আলোর দু’টি সবুজ, দু’টি লাল থাকে। উচ্চতা বা দূরত্বে গলদ থাকলে আলো অন্য রকম ভাবে জ্বলতে পারে।” ‘পাপি’ যদি জানায়, বিমানের উচ্চতা বা দূরত্ব ভুল রয়েছে, বিমান এক চক্কর ঘুরিয়ে এনে দ্বিতীয় বার নামতে হয় পাইলটদের। কোনও পাইলট এর অন্যথা করলে তাঁর লাইসেন্সও বাতিল হতে পারে। মনে করা হয়, ম্যাঙ্গালোরে ‘পাপি’-র নির্দেশ অগ্রাহ্য করে নেমে এসেছিলেন এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের পাইলট।
কলকাতা বিমানবন্দরের ‘পাপি’-র গন্ডগোলের বিষয়টি বিমান পরিবহণের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল এভিয়েশনের (ডিজিসিএ) গোচরে আনা হয়। তাদের নির্দেশে মাঝে বন্ধ করে দেওয়া হয় দ্বিতীয় রানওয়ের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে বিমান ওঠানামা। তখন দ্বিতীয় রানওয়ের
শুধু উত্তর প্রান্ত ব্যবহার করা হচ্ছিল। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে তদন্ত করে রিপোর্টও জমা দিতে বলেছে ডিজিসিএ। কলকাতায় ডিজিসিএ প্রধান সনিত কুমারের কথায়, “যাত্রী নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনও রকম আপোস করা হবে না। বুধবার পর্যন্ত বন্ধ রেখে বৃহস্পতিবার পরীক্ষামূলক ভাবে রানওয়ের দক্ষিণ প্রান্ত চালু করার পরে আবার সমস্যা দেখা দিয়েছে। আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ওই প্রান্ত।”
কর্তৃপক্ষের উদ্বেগ বাড়িয়ে পাইলটেরা বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, এ বার দ্বিতীয় রানওয়ের উত্তর প্রান্তে অবতরণের সময়েও ‘পাপি’-র বার্তা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। ‘পাপি’ যে উচ্চতার কথা জানাচ্ছে, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক নীচে থাকছে বিমান। সনিত কুমারের কথায়, “সত্যি যদি দেখা যায় রানওয়ের দু’প্রান্তের ‘পাপি’-ই ভুল বার্তা দিচ্ছে, তা হলে রানওয়ে বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই।” তবে উত্তর প্রান্তের ‘পাপি’ নিয়ে এখনও কোনও অভিযোগ তাঁর কাছে আসেনি বলেই জানান তিনি। ‘পাপি’-র এই গন্ডগোলে ভয়ানক সমস্যায় পড়েছেন কলকাতা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। এ দিন সারা দিন ধরে প্রধান রানওয়ে থেকেই বিমান ওঠানামা করে। কিন্তু, সেই রানওয়ের অবস্থা ভাল নয়। ফলে, সপ্তাহে অন্তত দু’তিন দিন কিছুটা সময় ওই রানওয়ে বন্ধ রেখে সারাই ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতেই হয়। তখন দ্বিতীয় রানওয়ে ছাড়া গত্যন্তর নেই। এখন যদি দ্বিতীয় রানওয়ে পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হয়, তা হলে সেই সময়ে কলকাতা থেকে বিমান ওঠানামা স্তব্ধ হয়ে যাবে।
বিমানবন্দরের অধিকর্তা বি পি শর্মা অবশ্য দাবি করেছেন যে, ‘পাপি’ সারানোর কাজ অনেকটাই হয়ে গিয়েছে। তাঁর কথায়, “ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ শেষ। এ বার দিল্লি থেকে একটি ‘বিশেষ’ বিমান এনে পরীক্ষা করে দেখা হবে ‘পাপি’ ঠিকমতো কাজ করছে কি না।” কিন্তু সারা ভারতের জন্য এমন পরীক্ষামূলক বিমান মাত্র দু’টিই রয়েছে। অনেকটা ভিভিআইপি-র সাক্ষাৎ পাওয়ার মতো সেই বিমানকে অনেক দিন আগে থেকে চেয়ে রাখতে হয়। যদিও অধিকর্তার আশ্বাস, সেই বিমান ডিসেম্বরের আগেই চলে আসবে। |