পুস্তক পরিচয় ২...
এমন অপচয় থেকে আমরা শিখব কি
আ বাঞ্চ অব লাইজ, ঋজু বসাক। ফাইন প্রিন্টস, ৪০০.০০
ত্যন্ত প্রাণবন্ত ছেলে, বন্ধুদের বলত, ‘...আমার মতো থাক, পুরো বিন্দাস্’, পাঁচজনের আনন্দের উৎস হতে পারত, অন্যের মুখে হাসি ফোটাত, দুঃখের ভাগ নিত, তার মুখে সর্বদা লেগে থাকত হাসি, নাচত, গাইত, গান লিখত, ছবি আঁকত, আলোকচিত্রে ধরে রাখত ভাললাগা দৃশ্য। অথচ আঠারো বছর পুরবার আগেই তার মনে হল, মরে যাওয়াটাই জীবনের নির্বিকল্প সমাধান! ঋজুকে যাঁরা চিনতেন, তাঁদের সুদূর কল্পনাতেও ছিল না তার এমন আত্মহননের সম্ভাবনা। স্কুলের যে শিক্ষকরা, যে পরিচিতরা, কাছাকাছি বয়সের যে-বন্ধুরা তার গুণের কথা, তার সদাহাস্যময়, মিশুকে, পরোপকারী ব্যক্তিত্বের কথা বইয়ের সূচনায় লিখেছেন, তাঁরা কেউ জানতেন না যে অষ্টম শ্রেণি থেকে ঋজু কবিতা লেখে, আর তার প্রায় সবেরই কেন্দ্রে আছে নিঃসঙ্গতা, মৃত্যু! অথচ ২০১২-র ১১ ফেব্রুয়ারি যখন সংবাদপত্রে বেরলো যে, দু’দিন আগে হারিয়ে যাওয়া ঋজুর দেহ পাওয়া গিয়েছে লেকের জলে, তাতেই জানা গেল, ঋজু কবরখানায় বেড়াত, সেখানে বসে লিখত।
ঋজু লিখেছে, এ দুনিয়ায় সুরের জায়গা নেই। কারণ বিশ্ব জুড়ে কেবল হিংসা, দ্বেষ, অস্ত্র, বোমা, লড়াই। নিজের প্রেমিকার ঘরে ঢুকে কবি দেখছে, মেয়েটি মূর্তিমতী বিষাদের মতো বসে আছে কবির ছবির সামনে। ক্যালেন্ডারে চোখ পড়তে বুঝছে কবি, একদিন আগে কবিকে শোয়ানো হয়ে গেছে কবরে, তাই প্রেমিকার এই বিষণ্ণতা। ১৫৯টি ইংরেজি আর ১টি ইংরেজি হরফে লেখা বাংলা কবিতার প্রায় সবগুলিতেই মৃত্যুর ইচ্ছা, মরণের উদ্যোগ, মৃত্যু অথবা মৃতদেহ ভর করে আছে নিদারুণ নিঃসঙ্গ কবিকে। অথচ এই ঋজুকে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত চিনতে পারেননি কেউ!
২০০৮-এ আই এস আই-এর প্রথম সারির ছাত্র সুগত ভট্টাচার্য ছাত্রাবাসের ঘরে আত্মঘাতী হয়েছিল। পরম গুণী সেই ছেলেটির কবিতা পড়েছেন পাঠক সুগতর মৃত্যু-পরবর্তী প্রকাশনায়। না, সেখানে এমন ঘোর ছিল না মৃত্যুর। বরং একান্ত মনে জীবনকে খুঁজতে খুঁজতে হন্যে হয়েছিল সে। কিন্তু ঋজুর তো সেই অষ্টম শ্রেণি থেকেই, মৃত্যুই কেন্দ্রীয় বিষয়। ইংরেজি সাহিত্যে তার আন্তরিক অনুরাগ, আধুনিক পাশ্চাত্য সুরে তার গভীর উন্মাদনা কিংবা শান্তি, রাজনীতিতে তার প্রবল আগ্রহ এ সবের হদিশ মেলে ঋজুকে নিয়ে স্মৃতিচারণগুলিতে। তারপর প্রশ্নচিহ্নের মতো জেগে থাকে ঋজুর কবিতা। ‘লিজার্ডস ডোন্ট ক্রাই’-এর সূচনায় আছে ‘গিভ মি অ্যানাদার চান্স,/ লেট মি জাম্প ফ্রম দ্য টলেস্ট টাওয়ার অব লন্ডন’, আর শেষে ‘... আই হ্যাভ টু শো দি ওয়ার্লড দ্যাট লিজার্ডস ডোন্ট ক্রাই’। এর রেশই কি পাই কবিতাগুচ্ছের সতর্ক নামকরণে? আজীবন যে-ঋজু আত্মজনের নাগালের বাইরে ছিল, অকালমৃত্যুর সূত্রেই সে কি নাগালে এল?
অত্যন্ত সুসজ্জিত বইটিতে ঋজুর জীবনের সব কীর্তি লিপিবদ্ধ আছে শংসাপত্রের প্রতিলিপি, পুরস্কারপ্রাপ্তির চিত্রে, ঋজুর পরম অনুরাগের সাহিত্যিক অমিতাভ ঘোষের পূর্বকথনে, চেনাজানাদের স্মৃতিচারণে। কাগজ, ছবি, হরফ সবই বড় বেশি সুন্দর। আর ঋজুর যে কবিতাগুলি স্মৃতিকথার পাশে আদ্যন্ত স্ববিরোধের উপমায় বিরাজ করছে, তা পড়তে গেলেই পাঠক দেখবেন, আপাত-সৌন্দর্য আর অযত্নের মর্মান্তিক সহাবস্থান। ‘smilling’ (27) থেকে ‘worm out’ (77) কত যে ভুল বানানে! end হয়েছে and (31), by হয়েছে my (105)! প্রাণ থাকতে ঋজুকে যাঁরা চেনেননি, অথবা বলা ভাল, ঋজুকে যাঁরা চেনাতে পারেননি চিন্তার, প্রতিরোধের, জীবনের কোনও বিকল্প দিশা, তাঁরা কি আজ ঋজুর মৃত্যু-সূত্রে প্রাপ্ত মরণগাথা, শোকগাথা, নিঃসঙ্গতার হাহাকারগুলি, যথাযথ অভিনিবেশে নিজেরা বুঝবার আগেই, সাড়ম্বরে তুলে দিচ্ছেন সবার হাতে?
স্বাভাবিক যে সাধারণের সংগতিই আজ ঋজুর আত্মজনদের জীবনধারণের একমাত্র উপায়, একমাত্র সান্ত্বনা। এ দায় কেবল ঋজু বসাকের আত্মজনের নয়। আমরা, যারা অভিভাবক, যারা শিক্ষক, তারা তো বুঝে উঠতে পারি না, চরম নির্দয় এই দুনিয়ায় কোথায় ত্রাণ ভবিষ্যের! আমরা না চিনি তাদের বিষাদ, না বুঝি তাদের বদ্ধতার যন্ত্রণা। আর যতই কম বুঝি ততই সাধ-আহ্লাদের ঘেরাটোপে বানিয়ে তুলি ঋজু বা তার মতো আর কারও এক অবয়ব। সংসার-সমাজ-অর্থনীতিসম্মত আকাঙ্ক্ষায় ভরপুর সে নির্মাণ, চাওয়া না-চাওয়ার নানা আরোপ যে ভবিষ্যের সংবেদনকে আঘাত করতে পারে, সে-বোধে আমরা রিক্ত। চরম সর্বনাশ ঘটে গেলেও হারিয়ে যাওয়া মানুষটি যদি ঋজুর মতো গুণী হয়, তবে তার গুণের বিজয়গাথায়, উষ্ণতার স্মৃতিগাথায় আমরা ধরিয়ে নিতে চাই পুরো ঋজুকে! খেয়াল করি না, মায়ের যৌবনবেলার একটি ছবির উল্টো পিঠে ঋজু লিখেছিল, ‘লেট মি ফ্লাই লাইক দ্য বার্ড সো ফ্ললেস/ ফর আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু বি দ্য প্রিজনার অব মাই ওন সাকসেস’ (64-65)। ‘স্মাইল’ নামের এই কবিতাটিই বোধহয় ১৬০টির মধ্যে সবচেয়ে বেশি জীবনের কবিতা।
ঋজু আর জীবনে ফিরবে না। এমন অপচয় থেকে আমরা কি শিখব আমাদের লালন-বন্ধন-সোহাগ-শাসনকে আর একটু নিবৃত্তির বোধে চিহ্নিত করতে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.