|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
ইতিহাস লেখার সোনার হরিণ |
অমিতাভ গুপ্ত |
বিয়ন্ড দ্য লাইনস: অ্যান অটোবায়োগ্রাফি, কুলদীপ নায়ার। রোলি বুকস, ৫৯৫.০০ |
এক জন নবতিপর সাংবাদিক, যিনি ভারতের স্বাধীনতা অর্জন দেখেছেন, ইন্দিরা গাঁধীর জরুরি অবস্থা দেখেছেন, আবার মনমোহন সিংহের আর্থিক সংস্কারও দেখেছেন, তাঁর আত্মজীবনী প্রকাশিত হলে আগ্রহ তৈরি হয় বইকী তিনি যে ভাবে কাছ থেকে ভারতকে দেখেছেন, ভারতকে বদলাতে দেখেছেন, তার স্বাদ পাওয়ার আগ্রহ। কুলদীপ নায়ারের আত্মজীবনী নিয়েও সেই কারণেই আগ্রহ ছিল। চারশো পাতারও বেশি দীর্ঘ এই আত্মজীবনীতে তাঁর নিজের জীবনের কথা যৎসামান্য এতটাই কম যে মাঝেমধ্যে সংশয় হয় ব্যক্তিগত জীবন বলে তাঁর আদৌ কিছু ছিল কি না তাঁর বইটা আসলে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের ইতিহাস।
বড় ইতিহাসের ফাঁকে ছোট ঘটনা লেখার অবকাশ বা মুনশিয়ানা খুব সুলভ নয়। ফলে, যে সব ছোটখাটো ঘটনা, টুকরো কথার দু’এক আঁচড়ে কোনও মানুষের ছবি এঁকে ফেলা যায় সহজেই, কুলদীপ নায়ার তেমন ঘটনার দিকে তাকানোর খুব সুযোগ দেননি নিজেকে। দিলে, বইটা কী হতে পারত, তার দু’একটা নমুনা এই বইয়েই আছে। গোবিন্দবল্লভ পন্থ তখন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনিই ‘ভারতরত্ন’ পাবেন। সেই পুরস্কারের মানপত্র লেখার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র দফতরেরই। যা-ই লেখা হয়, মন্ত্রীর কিছুই পছন্দ হয় না। কোনওটাই নাকি তাঁর মাপের যোগ্য সম্মাননা হয়। শেষ পর্যন্ত সমাধান করলেন কুলদীপ নায়ারই। তিনি তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে কাজ করেন। পন্থকে তিনি বললেন, ভাষা কোনও মতেই তাঁর কৃতিত্বের বর্ণনা করতে পারবে না। ফলে, মানপত্রে কিছুই লেখা উচিত হবে না। সে বছর ভারতরত্নের মানপত্র ফাঁকাই ছিল।
পুরস্কার নিয়েই আরও একটা চমৎকার ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন নায়ার। এমনিতে পদ্ম পুরস্কারের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করতেন প্রধানমন্ত্রী আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি শুধু তা ঘোষণা করতেন। কিন্তু এক বার রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ সেই তালিকায় একটা নাম জুড়ে পাঠালেন ‘মিসেস লাজারাস ফ্রম দ্য সাউথ’। তিনি কে, কেউ জানে না। অনেক খুঁজে শেষ পর্যন্ত চেন্নাইয়ে এক শিক্ষাব্রতীকে পাওয়া গেল, যাঁর পদবি লাজারাস। তাঁকেই জানিয়ে দেওয়া হল, তিনি পদ্মশ্রী পাচ্ছেন। সব স্থির, এমন সময় রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বার্তা এল, মিসেস লাজারাস এক জন নার্স। তিনি বিজয়ওয়াড়া থেকে হায়দরাবাদের পথে অসুস্থ রাষ্ট্রপতির সেবা করেছিলেন। সে বছর দু’জন মিসেস লাজারাস পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন।
এই গল্পগুলো চিত্তাকর্ষক হতে পারে, কিন্তু কুলদীপ নায়ারের পছন্দসই নয়। তিনি ইতিহাস লিখতে আগ্রহী। তাতেই সমস্যা। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের ইতিহাস লিখতে গেলে যে পরিশ্রম, যে যত্ন এবং যে পড়াশোনার বিস্তার অপরিহার্য, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে নায়ারের তার কোনওটাই নেই। তাঁর একটি অভ্যেস রয়েছে তিনি খাঁটি খবর, শোনা খবর এবং বিশুদ্ধ গুজবকে এক দরের করে ফেলতে পারেন অনায়াসেই। তাঁর ভারতের ইতিহাস রচনার প্রকল্পটিও এই দোষে মারা পড়েছে। তথ্যের সূত্র নির্দেশ নেই, বইয়ের শেষে গ্রন্থপঞ্জিও নেই। নায়ারের ইতিহাস রচনার প্রকল্প, অতএব, তাঁর বয়সের ভারে কাবু স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভরশীল। তার ফল হয়েছে মারাত্মক। গাঁধী-হত্যার দিনের কথা লিখেছেন তিনি। নেহরু নতমুখে প্রবেশ করলেন। বাপুর মৃতদেহ দেখলেন এবং তার পরেই দৌড়ে একটি পাঁচিলের ওপর উঠে বলতে আরম্ভ করলেন, দ্য লাইট হ্যাজ গন আউট অব আওয়ার লাইভস ইত্যাদি। পুরো ছবিটার মধ্যে কতখানি হাস্যকরতা রয়েছে, কুলদীপ নায়ার এক বারও সে কথা ভাবলেন না কেন, কে জানে? অনুমান করি, তিনি দুটো স্মৃতিকে একটাকে অন্যটার ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। দিল্লির দাঙ্গার সময় সত্যিই নেহরু এক মুসলমান পরিবারকে মারমুখী হিন্দু ও শিখ জনতার থেকে বাঁচাতে পাঁচিলে উঠে পড়েছিলেন। আর গাঁধীর মৃত্যুর পর রেডিয়োয় তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার সূচনাবাক্যটি ছিল ‘দ্য লাইট হ্যাজ গন আউট অব আওয়ার লাইভস’।
বইটিতে অসতর্ক মন্তব্যও প্রচুর। নায়ার লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইটহুড গ্রহণ করায় তিনি জাতীয়তাবাদী নেতাদের চোখে অনেকখানি নেমে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নাইটহুড কবে পেয়েছিলেন, আর জাতীয়তাবাদী নেতাদের তাতে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, দুটো এক গোত্রের তথ্য নয়। ফলে, পড়তে পড়তে সংশয় হওয়ায় মনে হল, এমন কারও কাছ থেকে যাচাই করে নেওয়া যাক, যাঁর জ্ঞান সর্বজনমান্য হবে। শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করায় তিনি তাঁর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন, এই বিষয়ে কোনও লিখিত আলোচনার কথা আমার অন্তত জানা নেই। কুলদীপ নায়ারের লেখায় রবীন্দ্রনাথ একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। এমন মন্তব্য লেখকের বিশ্বাসযোগ্যতা কমানো ছাড়া আর কিছু করে বলে মনে হয় না। |
|
ভি কে কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে কুলদীপ নায়ার। |
এমন উদাহরণ প্রচুর। যেমন, তিনি লিখেছেন, নেহরু প্রতি দিন লেডি মাউন্টব্যাটেনকে একটি চিঠি লিখতেন। এয়ার ইন্ডিয়ার কর্মীদের দায়িত্ব ছিল লন্ডনে সেই চিঠি পৌঁছে দেওয়া। কোনও দিন দেরি হলে তার বিস্তর জবাবদিহি করতে হত প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তথ্যপ্রমাণ থাকলে এটা মারাত্মক একটা খবর নিজের হাতের সমস্ত কাজ সামলে প্রতি দিন একটা করে প্রেমপত্র লেখা খুব কম কথা নয়। কিন্তু নায়ার তাঁর মন্তব্যটি ভাসিয়ে দিয়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছেন। কোথা থেকে এই খবর পেলেন, জানানোর দরকার বোধ করেননি।
ভারতীয় সাংবাদিকতার দুনিয়ায় কুলদীপ নায়ারের একটি বিশেষ পরিচয় রয়েছে তিনিই নাকি এ দেশে ‘গুজব সাংবাদিকতা’র জনক। পিতৃত্বের প্রশ্নটি আপাতত থাক, তবে গুজবকে খবর বলে চালিয়ে দেওয়ার রোগটি তাঁর বেশি পরিমাণে ছিল। এই বইও সেই রোগে আক্রান্ত। অপারেশন ব্লু স্টার নিয়ে অনেকটা লিখেছেন তিনি। বই প্রকাশের কিছু দিনের মধ্যেই দু’বার ক্ষমাপ্রার্থনাও করেছেন, অসত্য কথা লেখার জন্য। সাংবাদিক হিসেবে এটা খুব গৌরবের কথা নয়।
কুলদীপ নায়ারের সাংবাদিক সত্তা ভারতের স্বাধীনতার সমবয়সী। এই সময়ে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা কী রকম, লিখতে পারতেন তিনি। জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। সেই আন্দোলন নিয়ে এখনও তেমন তথ্যসমৃদ্ধ লেখার বেশ অভাব। সেই অভাব তিনি চাইলে অনেকটাই মেটাতে পারতেন। কিন্তু ইতিহাস রচনার সোনার হরিণ তাঁকে পথভ্রষ্ট করল। |
|
|
|
|
|