|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ ২... |
টিনএজ বায়নাক্কা |
কিন্তু কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার পরিণতি? মনোবিদ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে লিখছেন স্বাতী বসু |
বয়ঃসন্ধি |
কনফিউশন এবং কনফ্রন্টেশন যে বয়ঃসন্ধির বা টিনএজের ধর্ম, সে তো ক্লিশে। শারীরিক পরিবর্তন, প্রখর ইগো বা আত্মসচেতনতা, অদম্য-অনিবার্য কৌতূহল নিয়ে এই সময়টা মানসিক ঝড়-ঝঞ্ঝার সময়, তাও অজানা নয়। শুধু যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই বয়সের অর্থাৎ ১৩ থেকে ১৯-এর ছেলেমেয়েদের নিয়ে তৈরি হওয়া সমস্যার চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটেছে। |
শিকেয় খেলাধুলা |
বাবা-মায়েরা যখন ভীষণ ব্যস্ত, যৌথ পরিবার ভেঙে যখন টুকরো হয়ে গেছে, ফ্ল্যাট বাড়িতে বোকার মতো একা জীবনধারণটাই যখন নিয়ম, মাঠে-ময়দানে ছুটোছুটি খেলা কিংবা কাদামাটিতে ফুটবল যখন শহুরে টিনদের কাছে প্রাগৈতিহাসিক, তখন চোখধাঁধানো শপিং মল-এর ঠান্ডা ঝকঝকে ভেতর বা বাইরের বাঁধানো রোয়াক-ই ওদের মনের আরাম। আগে ছিল কেবলই ফার্স্ট টার্ম, সেকেন্ড টার্ম, অ্যানুয়াল। স্কুলগুলোতে এখন চলে ইউনিট টেস্টের ঘনঘটা। বিশ্রাম না-পাওয়া, খেলার অবকাশ না-পাওয়া বাচ্চাগুলো কম্পিউটার বা ইন্টারনেট, মোবাইলের হালফিলের দুনিয়ায় আকৃষ্ট হবে না কেন? বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে হট্টমেলার আসর এখন বন্দি এইচ এস জে ই ই, এ আই ই ই ই-পাঠের কংক্রিটের ঘরে যেখানে তাকে চটজলদি এমসিকিউ কষে ফেলার মন্ত্র শিখে নিতে হচ্ছে। ‘ডাকছে আকাশ, ডাকছে বাতাস’ বললে যে পিছিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু কৈশোর বা বয়ঃসন্ধির যে অফুরান প্রাণশক্তি, তার স্ফুরণ কত দিন দমিয়ে রাখা সম্ভব? |
মনোবিদরা কী বলছেন? |
মনোবিদ কেদাররঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় সাফ জানালেন, “শৈশব থেকে সন্তানকে টিভি কিংবা মোবাইল ফোনের রঙিন দুনিয়ার হদিশ বাবা-মায়েরাই দেন। তিন বছরের বাচ্চা খাচ্ছে না। ওষুধ? পোগো বা কার্টুন নেটওয়ার্ক। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা বাচ্চা বিরক্ত করছে। উপায়? হাতে সেলটা গুঁজে গেমস চালিয়ে দিলেই কেল্লাফতে। সারা দিন অফিস করে রাতে বাড়ি ফেরার পরে সন্তানের মুখে ওই হাসিটা কিনতে এক প্যাকেট ডমিনোজ বা কুরকুরে বা দামি কোনও উপহার আনলেই তো হল। ক্লান্ত বাবা-মায়ের আর সন্তানের জন্য কোয়ালিটি টাইম কোথায়? এর ফল? সন্তানের উদ্ধত আচরণ।”
শোনা যাক দুই টিনএজ ছেলেমেয়ের মায়ের কথা। “বায়নার শেষ নেই। পোশাক-আশাক থেকে খাওয়াদাওয়া সব কিছু নিয়ে অশান্তি। আমাদের ছোটবেলায় শুধু রবিবার মাংস রান্না হত। এখন? ফি দিন মাংস চাই। শাকসব্জি না পসন্দ।” বিরক্ত ওই মায়ের বক্তব্যে পরিষ্কার টিনএজ বায়নাক্কা খাবার টেবিল পর্যন্ত গড়িয়েছে। মনোবিদ কেদারবাবুর বক্তব্য, মাংস কিনে এনে রোজ রেঁধে দেন কে? সব্জি না খাওয়া তো এখন ফ্যাশন। চুলের কন্ডিশনার স্পাইক ছাঁটের পয়সা কে দেন? অফ-শোল্ডার জামাটাই বা সাধ করে শপিং মল থেকে কে কিনে আনেন? অথচ মূলেই এ হেন অভ্যাস বিনষ্ট করতে পারলে ব্লেড দিয়ে শিরা কেটে পরীক্ষা দেব না, খাব না জেদ দেখিয়ে বা ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বা অন্য উপায়ে আত্মহত্যা করে বাবা-মাকে শিক্ষা দেওয়ার উপক্রম হয় না। |
|
টিনএজ সমস্যার রকমফের... |
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রিমা মুখোপাধ্যায় জানালেন, “মানসিক চাঞ্চল্য, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, মোটিভেশনের অভাব সম্পর্কিত জটিল সমস্যায় আক্রান্ত আজকের টিনএজাররা। বয়ঃসন্ধিকালে প্রেমে পড়া বা না পড়া উভয়ই সমস্যা।” চেহারার কোনও খুঁত বা কোনও কারণে বন্ধু বা পিয়ারগ্রুপে গুরুত্ব না পাওয়া, টিজড হওয়া নিয়ে হীনমন্যতা তৈরি হয়। আবার বন্ধুদের দামি মোবাইল, বন্ধুদের জন্মদিন শপিং মল-এর ফুডকোর্টে, আমার কেন হবে না এ সব নানাবিধ কারণে দ্বন্দ্ব, ক্রমে বাবা-মা আর সন্তান দুই যুযুধান পক্ষে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। এ সবের থেকে স্কিজোফ্রেনিয়ার মতো কঠিন মানসিক ব্যাধিও হতে পারে। |
কী বলছেন শিক্ষাবিদ, সমাজতাত্ত্বিক? |
যে সন্তানকে আবর্তিত করে আমাদের জীবন, যার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম, নামী স্কুল থেকে দামি পোশাক, ভাল থাকা খাওয়া তার সঙ্গে ঠিক কোথায় সম্পর্কের বিস্তর ফাটল ধরছে? কেনই বা গভীর ক্ষত তৈরি হচ্ছে কিশোর মনে? তাকে গড়তে আমাদের কোথায় ফাঁক থেকে যাচ্ছে? সম্পর্কের মূল্যই তারা বুঝছে না। লা মার্টিনিয়ার ফর বয়েজ-এর প্রধান শিক্ষক সুনির্মল চক্রবর্তীর কথায়, আজকে যখন তথ্য প্রযুক্তি তথা মিডিয়ার রমরমা, বিভিন্ন ইলেকট্রিক গ্যাজেটস-এর প্রভাব যখন তুঙ্গে, তখন সন্তান প্রতিপালন একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে টিনএজার ছেলে বা মেয়ের দাবি-দাওয়া- চাহিদা থাকবেই। বোঝানোর গুরুদায়িত্ব বাবা-মার।
বাচ্চাদের উপর চাপ, কী করা উচিত-অনুচিত বিষয়ে এক টিনএজারের বাবা হিসেবে অভিনেতা কৌশিক সেন স্পষ্টই বললেন, ছেলে ঋদ্ধিকে বলে দিয়েছি পড়াশুনোটা শেখো, তবে ফার্স্ট হতে হবে না। সব বিষয় নিয়েই ঋদ্ধির সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করেন ওর বাবা-মা। কৌশিক মনে করেন, কো-কারিকুলার স্ট্রেস বাস্টারের কাজ করে। বাবা-মা-সন্তান এই ত্রিভুজের কমন ইন্টারেস্টের জায়গাটাও জানা জরুরি। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক শমিত কর বলছিলেন, “বাবা-মায়েদের স্বাভাবিক মানসিকতা এই যে আমাদের থেকে যেন অনেক ভাল থাকে আমাদের সন্তানেরা। এই ভাল রাখতে গিয়ে বিপত্তি।” তবে সংসারেও নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলার দরকার আছে বলেই মনে করেন শমিতবাবু। |
অতএব? |
প্যাম্পার্ড বা স্পয়েল্ট ব্র্যাট নয়, সুসন্তান গড়ার কর্মযজ্ঞে ইমোশন অপেক্ষা পার্মুটেশন কম্বিনেশন জরুরি। আধুনিক জীবনে খুব প্রয়োজনীয় সেলফোনটাতেই যখন নেট সংযোগ নিয়ে গোটা দুনিয়াটাকে পুরে ফেলা যাচ্ছে, তখন খুব বেশি পাহারা দিয়ে বা অতিরিক্ত শাসন করে ক্ষতি বই লাভ নেই। মদ থেকে পর্নো আজ সবই সহজলভ্য। স্কুল, পাড়া বা হাউজিং বা পুলকারের বন্ধুদের কাছ থেকেই দেখবেন কত তথ্য জোগাড় করে আনছে আপনার সন্তান। কতটাই বা নজরবন্দি করতে পারবেন শাণিত বুদ্ধিসম্পন্ন আজকের টিনদের? এখন উপায় ওদের ভেতরেই প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা এবং সচেতন ভাবে প্রক্রিয়াটা ছোট থেকে শুরু করা। |
সমাধান |
• আধুনিক জীবনে সেলফোন থেকে ওকে সরানো মুশকিল। কিন্তু তার ব্যবহার যেন নিয়ন্ত্রিত থাকে।
•
কিছু চাইলেই তা সঙ্গে সঙ্গে হাজির করবেন না।
•
শুধুই পড়াশোনা নয়, সন্তানের রিল্যাক্স করার সময়ও নিশ্চিত করুন।
• সন্তানকে সামলাতে নিজেদের লাইফস্টাইলেও পরিবর্তন আনুন।
•
বয়ঃসন্ধির সময়ে সন্তানকে ঠিক মতো মোটিভেট করুন।
•
ও একটু বড় তো হয়েইছে। সেই মর্যাদা ওকে দিন।
•
সন্তানের বন্ধু-বান্ধবদের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকুন। তাদের ফোন নম্বর হাতের কাছে রাখুন।
•
সন্তানের সামনে দাম্পত্য কলহ নয়।
•
লেখাপড়া থেকে একস্ট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি আপনার অতিরিক্ত আশার বলি যেন ও না হয়। মনে রাখবেন ও আপনার
জেরক্স নয়।
|
ঘটনা ১: বীরভূমের নলহাটিতে একাদশ শ্রেণির দুই ছাত্রের ক্রিয়াকলাপ
খবরের কাগজে পড়ে আমরা স্তম্ভিত। ‘চড় খেয়ে বাইরে থেকে লোক
জুটিয়ে মার শিক্ষককে।’ শাসন করার ‘অপরাধে’ শিক্ষককেই দারুণ
‘শিক্ষা’ দিয়েছে ওই ছাত্রেরা। প্রার্থনার সময় শৃঙ্খলাভঙ্গ কী
এমন অপরাধ? প্রশ্ন তাদের। |
ঘটনা ২: ঠিক ক্লাসে ওঠার পরীক্ষার আগে নাইনে পড়া প্রবুদ্ধের আবদার নিজস্ব মারুতি সুইফট। মফস্সলের সেই ছেলের ‘প্রভাবশালী’ বাবাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাফ পরামর্শ, ‘না বলে দিন ছেলেকে’। মাধ্যমিক দেবার আগে ও হন্ডা সিটি চাইবে না কে বলতে পারে? বাবার বক্তব্য, এলাকায় তার নাম-ডাক, পরিচিতির যে সর্বনাশ হয়ে যাবে। |
|
ঘটনা ৩: অয়নের প্রথম দাবি ছিল ক্যামেরা মোবাইল। তার পর টাচস্ক্রিন। পেশায়
অধ্যাপক বাবাকে দুপুর রোদে ঠেলে পাঠিয়ে সে বাধ্য করেছে আইপড কিনে আনতে।
তারপর একে একে ব্র্যান্ডেড সানগ্লাস, ফি মাসে দামি জিনস, টি-শার্ট। না দিলে?
আগে দু’তিন বার কাচের আলমারিতে ঘুষি মেরে সে হাত রক্তাক্ত করেছে। ভাঙা কাচ
নিয়ে তেড়ে গেছে মাকে ‘শেষ’ করে দিতে। ছেলে এও জানিয়েছে তার দাবি মানা না
হলে সামনের বছর মাধ্যমিক দেবেই না! একের পর এক অশান্তি। অগত্যা... |
ঘটনা ৪: পম্পি কর্পোরেট কর্তার একমাত্র সুইট হার্ট, ডার্লিং ডটার।
ক্লাস এইটে পড়া স্টাইলিশ মেয়ের চুল মেনটেন করতে প্রতি সপ্তাহে
পার্লার যেতেই হয়। অবসরে ডিভিডি-তে মুভি দেখতে বা কম্পিউটার
গেম খেলতে খেলতে পিৎজা, মোমো, কোক মাস্ট। গৃহশিক্ষক থেকে
কাজের মাসি কালো হলে পম্পির চলবে না। বিত্তবান বাবা হাল
ছেড়ে বলেন যুগের হাওয়া। বয়সের দোষ। |
|
ঘটনা ৫: সোমঋতা বাবা-মার একমাত্র মেয়ে। ছোট থেকেই একগুঁয়ে। চাহিদার পর চাহিদায় জেরবার ওর বাবা-মা। স্বামীর ব্যয়বহুল চিকিৎসা, মেয়ের পড়াশুনার খরচ টানতে টানতে হাঁপিয়ে ওঠা মেয়ের মা সন্তানকে অনেক বুঝিয়েছেন।
বাবা হাসপাতালে ভর্তি হতেই ওর মা নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সুযোগ বুঝে মেয়েও আত্মহত্যা করে বসে। সোনারপুরে সাম্প্রতিক এই ঘটনায় বাকরুদ্ধ প্রতিবেশীরা। কান্নার ভাষাও যেন নেই। সতেরো বছরের একটা মেয়ে এত অবুঝ!
সত্যি কোথা থেকে কী যে ঘটে গেল। |
|
|
|
|
|
|