শনিবারের নিবন্ধ ১...
বাবার বিয়ে দেখলাম
“এটা কি বাবার বিয়ে পেয়েছিস নাকি?”
প্রশ্নটার মধ্যে রয়েছে খানিকটা মজা। অনেকটাই তাচ্ছিল্য। যার মানে দাঁড়ায় যে এটা একটা অবাস্তব চিন্তা। কিন্তু সময় বদলেছে। বাবা মায়ের বিয়েতে যাওয়া এখন আর অকল্পনীয় ঘটনা নয়। এই তো বাবার বিয়ে দেখল সইফ আলি খান আর অমৃতা সিংহের ছেলে-মেয়ে সারা আর ইব্রাহিম। সইফিনার সঙ্গীত থেকে বিয়ের পার্টিতে হইহই করে সেজেগুজে হাজির তারা। তাহলে কি বাবা-মায়ের বিয়ে দেখাটা এই প্রজন্মের নতুন ট্রেন্ড?
২০১০ সালে শশী থারুর ও সুনন্দা পুষ্করের বিয়ে হয় কেরলের এলাভেনচেরি গ্রামে। দুজনেরই আগের পক্ষের ছেলেমেয়েরা উপস্থিত ছিল সেই বিয়েতে। থারুরের প্রথম পক্ষের স্ত্রী তিলোত্তমা মুখোপাধ্যায়ের যমজ সন্তান কানিশ আর ঈশান, সুনন্দার আগের পক্ষের ছেলে শিব তিন জনই হাজির ছিলেন বাবা-মায়ের দ্বিতীয় বিয়েতে। কানিশ আর ঈশান তো ঘরে বরণ করে তোলার সময় সুনন্দাকে বলেছিল, “আম্মা ওয়েলকাম টু দ্য ফ্যামিলি।”
ঘটনা অনেকটা ওই রকমই ছিল কলকাতার পরিচিত সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র যখন বিয়ে করেন। দেবজ্যোতি বলেন, “আমার স্ত্রীর দুই সন্তান সাগ্নিক আর স্পন্দনা। স্পন্দনার তখন বয়স চোদ্দো। সাগ্নিকের উনিশ। বিয়ের আগে আমার স্ত্রী জোনাকি ওদের বলে, আমি ওঁর সঙ্গে ভাল থাকব। তোমরা কী বল? ওদের বক্তব্য ছিল যে মা যদি ভাল থাকেন, তা হলে ওরা খুশি।”
বিয়ের দিন স্পন্দনা বেশ খানিকটা খুনসুটিও করেছিল। “আমাকে ফোন করে বলেছিল, ‘ডোন্ট গেট লেট। উই আর কিপিং ইওর ব্রাইড রেডি’। আমাদের একটা ছোট অনুষ্ঠানও হয়েছিল। রেজিস্ট্রি, তার পর একটা গেট টুগেদার। ওরা ভীষণ অ্যাকটিভ ছিল আমাদের বিয়েতে। ওদের দেখে জোনাকি আর আমিও বেশ সহজ বোধ করছিলাম। আজকে, উই আর ওয়ান হ্যাপি ফ্যামিলি। স্পন্দনা আমায় বাবা ডাকে। সাগ্নিকের কাছে আমি দেবুদা,” দেবজ্যোতি বলেন।
যদি ভেবে থাকেন যে সেলিব্রিটিদের জগতেই এ সব হওয়া সম্ভব, তা হলে এই ঘটনাটি শুনুন।
বিয়ের সাজে করিনা-সইফ।
১৯৯৯ সালে, ব্যাঙ্ক কর্মচারী গোবিন্দনারায়ণ রায় তাঁর স্ত্রীকে হারান ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতে। ঘটনার পর স্বভাবতই একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। তখন তাঁর ছেলে তাঁকে শক্ত হতে সাহায্য করেন। “অর্ণব যে বছরে মাধ্যমিকে থার্টিন্থ হয়, সে বছরই ওঁর মা মারা যান। আমি প্রায় পাগল হয়ে যাই। কিন্তু আমার ছেলের স্ট্যামিনা দেখে আমি তাজ্জব হয়ে যাই। কষ্ট কি ওর হয়নি? হয়েছে। অথচ আমার সামনে এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলেনি। স্ত্রীর মৃত্যুর দু’বছর পরে আমার এক দিদি লন্ডন থেকে আমাদের বাড়িতে আসেন। উনি আমাকে বোঝান যে আমার এবার বিয়ে করা উচিত। দিদি চলে যাওয়ার পরে অর্ণবও একই কথা বোঝায়,” গোবিন্দবাবু বলেন। শেষমেশ রাজি হন গোবিন্দবাবু। পাত্রী দেখতে যাওয়ার সময় ছেলেই সঙ্গে যায়। “পেপারে বিজ্ঞাপন দেখে মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। প্রথম পাত্রীকে দেখতে গিয়ে আমি কথাই বলতে পারিনি। দ্বিতীয় জনকে দেখার পরে আমরা ঠিক করি যে ওখানে বিয়ে হবে। বিয়ের দিন আমার ছেলেই আমাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। বিয়ের রেজিস্ট্রিতে আমার ছেলে উইটনেসও হয়েছিল। তখন ওর বয়স সবে উনিশ বছর। আমি ওর কাছে স্বীকার করেছিলাম, ওর জায়গায় আমি থাকলে কিছুতেই বাবার বিয়ে দিতে পারতাম না। কিন্তু অর্ণব আলাদা। ওই আমাকে আর আমার স্ত্রী সুচরিতাকে বরণ করে। সুচরিতাকে ও মামন বলে ডাকে। যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং, তারপর আইআইএম থেকে এমবিএ করে ও এখন কুয়েতে চাকরি করছে,” গোবিন্দবাবু বলেন।
গোবিন্দবাবুকে অবশ্য অনেকেই বলেন যে ওঁর জীবনের ঘটনাটা একটা সিনেমা স্ক্রিপ্টের মতো। যেমন হয়েছিল ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’, ‘গোলমাল ৩’, ‘প্যার মে টুইস্টে’। সচরাচর এমন ঘটে না। কিন্তু খবর নিলেই জানা যাবে, গোবিন্দবাবুর মতো আরও অনেকে আছেন এ শহরেই। তাঁরা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন। তাঁদের ছেলেমেয়েও ব্যাপারটি মেনে নিয়েছেন। তাঁরা অনেকেই বলেন যে, এ কোনও নতুন ঘটনা নয়। আগেকার দিনে এসব আকছার দেখা যেত। স্ত্রী মারা গেলে শ্যালিকাকে বিয়ে করাটা বহু দিনের পুরনো প্রথা, যাতে সন্তানেরা তাদের মায়ের অভাব বোধ না করে।
স্পন্দনা, দেবজ্যোতি ও জোনাকি
এখনকার দিনে অবশ্য সমকামী কাপলরাও তাঁদের সন্তানদের সামনে নিজেদের এনগেজমেন্ট সারছেন। অলকা আর সোনালি যেমন। কলকাতার লেক কালীবাড়িতে গিয়ে ওঁরা যখন বিয়ে করেন, তখন অলকার প্রথম পক্ষের ছেলেও দিব্যি খুশি হয়। বিয়ের ঠিক আগে মায়ের এনগেজমেন্ট পার্টিতে সে ছিল স্টার অ্যাট্রাকশান। “অলকার ছেলে আমার বন্ধুর মতো, আমাদের বিয়ের সময় ও মুম্বই ছিল। তবে এনগেজমেন্ট পার্টিতে ও ভীষণ হইহুল্লোড় করেছিল। আমাদের এনগেজমেন্ট রিংটা চুজ করতেও সাহায্য করেছিল,” সোনালি বলেন।
মনস্তত্ত্ববিদ জয়রঞ্জন রামের মতে, “এ সব কিছুর পেছনে রয়েছে একটা বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস বলে, যে কোনও প্রতিকূল অবস্থাতেও মানুষের ভাল থাকার ইচ্ছেটা চিরন্তন। কাজেই বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরেও মানুষের সুখী থাকার অধিকার আছে। রিকনস্টিটিউটেড পরিবার এখন একটা বাস্তব। আমারও এক বন্ধু কিছু দিন আগে দ্বিতীয় বার বিয়ে করলেন। তাঁর স্ত্রীরও এটা দ্বিতীয় বিয়ে। বিয়েতে দু’জনের প্রথম পক্ষের পাঁচ জন ছেলেমেয়ে উপস্থিত ছিল। আজকাল তো শুনি ওঁরা একসঙ্গে সবাই বেড়াতেও যায়। যদি আগের সম্পর্কটি রিজেনেবলি ভাল থাকে, তা হলে এই সব সিচুয়েশন নিয়ে কোনও সমস্যা হয় না। এই রকম সম্পর্ক তখনই সম্ভব যখন একটা মিউচুয়াল রেসপেক্ট থাকে। সমস্যা হয়, যখন একজন এক্স নতুন সম্পর্কটি ভাঙার জন্য সাবোটেজ করার চেষ্টা করেন। এসব ক্ষেত্রে মনোবিদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।”
মনস্তত্ত্ববিদরা এও বলেন, একটা ভেঙে যাওয়া দাম্পত্য-সম্পর্ককে জোর করে জুড়ে দেওয়া যায় না। তাতে কারও ভাল হয় না। তেমনই বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর নতুন করে বিয়ে করাটাও অপরাধ নয়। অনেকে বাচ্চার কথা ভেবে পিছিয়ে আসেন। কিন্তু ঘটনা হল, বাচ্চারা খুশিই হয় যদি দেখে তাঁদের বাবা বা মা নতুন সম্পর্কে খুশি আছে। তাঁদের কাছে বাবার বিয়ে দেখাটা একটা চার্মও। দেবজ্যোতি-জোনাকির মেয়ে স্পন্দনার ভাষায়, “আমার মা যদি বাবাকে বিয়ে করে আনন্দে থাকেন, এর থেকে ভাল খবর আর কী হতে পারে? আমি ক্লাস নাইনে পড়তাম যখন বাবা-মা’র বিয়ে হয়। মাকে আমার বন্ধুরা পছন্দ করতই, বাবাও আমার বন্ধুদের কাছে ভীযণ পপুলার। ওঁদের বিয়ের পরের দিন স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সব গল্প বললাম। অবশ্য আমার বন্ধুদের মধ্যে এই রকম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কারও ছিল না। তবে আমি বলব, এ রকম ঘটনা যদি কারও জীবনে আসে, তার উচিত বাবা-মায়ের নতুন অধ্যায়কে মেনে নেওয়া। মন খোলা রেখো। তাঁদের আনন্দ তোমার জীবনে খুশির ছোঁয়া
এনে দেবে।”
আগে ভাবা, বিয়ে পরে
বাচ্চাকে আগে থেকে প্রস্তুত করুন আপনাদের বিয়ের জন্য, হঠাৎ করে খবরটা না জানানোই শ্রেয়
আপনার এক্স নতুন জীবন শুরু করতে চাইলে কখনও তাঁকে ছোট করবেন না আপনার বাচ্চার সামনে
• এক্স এবং নতুন পার্টনারের মধ্যে কোনও তুলনাতে যাওয়া উচিত নয়
• নতুন পার্টনারকে সময় দিন আপনার বাচ্চার সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক গড়তে
• বাচ্চাকেও সময় দিন যাতে সে আলাদা ভাবে সময় কাটাতে পারে আপনার নতুন জীবন-সঙ্গীর সঙ্গে
তথ্য: মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.