ইতনা সান্টানা কিঁউ হ্যায় ভাই
সান্টানার প্রথম অ্যালবাম রিলিজ হয় ৬৯-এ। সে বছরই উডস্টক-এ ফ্রি-জ্যাম সমৃদ্ধ তাঁদের তাক-লাগানো পারফরম্যান্স। আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের দুনিয়ায় সিংহবিক্রমে প্রবেশ। ওঁদের প্রথম এল পি-র মলাটেও ছিল এক ক্রুদ্ধ সিংহের মুখ। সেই সিংহকেই যেন নতুন করে দেখতে পেলাম বেঙ্গালুরুতে। সান্টানার অনুষ্ঠান মঞ্চে। ডেনিস চেম্বার্স যে ড্রাম সেটটি বাজালেন, তার কিক ড্রামসের গায়ে আঁকা অবস্থায়। সান্টানা সিংহের মিউজিক্যাল জার্নি সেই ফ্লাওয়ার-পাওয়ার যুগ থেকে এই জেট যুগেও দিব্যি বহমান। খিদে আজও মেটেনি!
তবে এতদিন ধরে সঙ্গীত জগতে নিজের আসন টিকিয়ে রাখতে হলে বারবার বদলাতে হয় নিজেকে, প্রকাশিত হতে হয় ‘নব নব রূপে’। আর এ বিষয়ে সান্টানার সঙ্গে পাল্লা কেই বা দিতে পারবেন? ভাবুন তো রক মিউজিকের ইতিহাসে ’৬৭-’৬৯, এই সময়কালের গুরুত্বের কথা! কে না কে কাজ করেছেন এ সময়ে! যুগান্তকারী কী কী সব অ্যালবাম ওই দু-তিন বছরে বেরিয়েছে! বিটলস নিজেকে নতুন ভাবে সার্জেন্ট পেপারের মোড়কে পেশ করলেন। ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’, ‘লেড জেপলিন’ এলেন। এলেন ‘ডোরস’ও তাঁদের প্রথম অ্যালবাম নিয়ে। এসেছেন ‘গ্রেটফুল ডেড’, জাঁকিয়ে কাজ করছেন ‘রোলিং স্টোনস’। কাজ করছেন ‘জেথ্রো টাল’। এই তো সবে শুরু হল জিমি হেনড্রিক্সের বর্ণময় কেরিয়ার! আর আজ, ২০১২। এঁদের বেশির ভাগেরই কাজ ফুরিয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন জীবন অনেককেই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। তারই মধ্যে কেউ কেউ অতীতের স্মৃতি বহন করে আজও টিম টিম করে অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন। যেমন রজার ওয়াটার্স আজও ফিরি করেন ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’-এর স্মৃতি। ম্যাকার্টনি আজও অনুষ্ঠান করেন। ইয়ান অ্যান্ডারসন প্রমাণ করে বেড়ান ‘জেথ্রো টাল’ বলতে শুধু তাঁকেই বোঝায়। সেরকম ভাবে বলতেই পারেন... কার্লোস সান্টানা, সে যতই আইনি যুদ্ধে জয়ী হয়ে সান্টানা ব্র্যান্ড-নেম ও লোগো ব্যবহারের অধিকার পেয়ে থাকুন না কেন, রাখতে পেরেছেন কি ‘হল অফ ফেম’-এ জায়গা পাওয়া তাঁদের প্রথম দুই অ্যালবামের ব্যান্ড লাইনআপকে? কেউই তো অবশিষ্ট নেই তখনকার, একমাত্র কার্লোস বাদে? আমি বলব... ঠিকই বলেছেন, তবে একটা জিনিস ভেবে দেখুন, পুরনো ঘোড়াদের মধ্যে একমাত্র সান্টানারই প্রতি দশকে ন্যূনতম একটি করে হলেও সুপারডুপার ইন্টারন্যাশনাল হিট আছে। এর মূলে কিন্তু সব দিক বাঁচানো ব্যান্ড সামলে চলার মানসিকতা নেই। আছে নিঃশর্ত এবং স্বাধীনভাবে নিজের ভাল লাগার সাউন্ডকে বাঁচিয়ে রাখার হিম্মত। পালটে যাওয়া সময়ের দিকনির্দেশকে পড়ে ফেলা ও তাকে ফলো করার মুরোদ। হয়তো সেজন্যই সিংহ আজও গর্জন করছে তাঁর গিটারে। সান্টানার সঙ্গীত জীবনে সান্নাটা নেমে আসেনি এখনও।
|
রূপমের প্লে লিস্ট |
• ব্ল্যাক ম্যাজিক ওম্যান
• মারিয়া মারিয়া
• ওয়ে কোমো ভা
• ইউরোপা
• জিঙ্গো |
|
• সোল স্যাক্রিফাইস
• সাম্বা পা তি
• ইভিল ওয়েজ
• স্মুদ
• দ্য গেম অব লাভ |
|
কিতনে আদমি থে?
কার্লোস সান্টানা একাই আসলে পাঁচজন। কাজ হিসেবে তাঁর এই পাঁচ চেহারা যদি পর্যালোচনা করি, তবে প্রথম দুই হলেন ব্যান্ড সান্টানা এবং সোলো প্রজেক্ট সান্টানা। অন্য বিভাগগুলোর কথায় পরে আসছি। যাদের মধ্যে কোনও মুখ আজও শাখাপ্রশাখা বিস্তারের মিউজিকাল ছুতো খুঁজছে। কিছু আবার ছুটি নিয়েছে। যেমন, তথাকথিত রক অ্যান্ড রোল ব্যান্ড অস্তিত্ব বিদায় নিয়ে তৈরি হয়েছে সান্টানা প্রজেক্টের জ্যাজ ফিউশন ‘বিগ ব্যান্ড’ সাউন্ড। প্রথম দিকে ব্যান্ডের ডিরেকশন ছিল হার্ড রকের অভিমুখে। যেখানে আফ্রিকান বা লাতিন আমেরিকান ছন্দকে জাস্ট উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। কার্লোস নিজে কিন্তু চাইছিলেন জ্যাজ ফিউশন তৈরি করতে। তাই মনোমালিন্য। শুরু হয়ে গেল সভ্য বদলের খেলা। আজকের সান্টানা তাই ‘সেশন’ মিউজিশিয়ানে ঠাসা। কাজেই বেশ কিছু সদস্য বহু দিন ধরেই আছেন জানলেও চট করে একে ব্যান্ড বলতে পারবেন না কেউই। ভয় লাগবেই, কার্লোস যদি একার মর্জিতেই আবার বদল আনেন?
এখন যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো রাউল রেকো। সান্টানার কঙ্গা বাদক। অনুষ্ঠানের পরদিন সকালে দলবল সমেত সান্টানাকে বেঙ্গালুরু এয়ারপোর্টে এয়ার ইন্ডিয়ার প্রাইভেট লাউঞ্জে বসে থাকতে দেখেছিলেন কলকাতার গিটারিস্ট-প্রোগ্রামার রাজকুমার সেনগুপ্ত। হাজার চেষ্টা করেও কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে তাঁর ধারেকাছে যেতে পারেননি। অবশ্য রাউল সিগারেট খেতে বেরনোয় তাঁকে ধরে অটোগ্রাফটা আদায় করেছেন তিনি। ওঁর কাছে এই অনুষ্ঠান দেখাটা স্বপ্নপূরণের মতো। প্রত্যেকটি গান ওঁর মুখস্থ। বললেন, ‘‘শো দেখতে দেখতে বার তিনেক কেঁদেই ফেলেছি।’’ রাজকুমারকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম, কার্লোসের আর একটি অবতারের কথা। যে অবতারকে আমরা, শ্রোতারা বার বার দেখেছি — কার্লোস কেমন সাবলীল ভাবে অন্য বিখ্যাত শিল্পীদের বিখ্যাত গান নিজের মতো করে বাজান! এই প্রবণতাকে বিষয় করে তিনি ‘গিটার হেভেন’-এর মতো আশ্চর্য অ্যালবাম বের করেছেন। এমনকী ওঁর অন্য অ্যালবামেও এর ছোঁয়া পাওয়া যায়। যেমন ‘অল দ্যাট আই অ্যাম’ অ্যালবামে বাজিয়েছেন নুসরত ফতে আলি খানের সুর, লাইভ কনসার্টে বাজিয়েছেন মাইকেল জ্যাকসনের ‘স্ট্রেঞ্জার ইন মস্কো’। তা’হলে বেঙ্গালুরুর প্রোগ্রামে কেন দেখা গেল না এমন সান্টানাকে, যে কিনা হঠাৎই মনের খেয়ালে বাজিয়ে উঠবেন এ আর রহমান বা রবিশঙ্কর বা রবীন্দ্রনাথ...!
এ রকম সান্টানা আমার স্মৃতিতে ছিলেন, কার্যত তাঁকে সেদিন দেখতে পেলাম না। |
আরেক জন সান্টানা হলেন কমপ্লিমেন্টর সান্টানা। ইনি আধুনিক ভাবনার লোক। আধুনিক সঙ্গীতের জগতে ইনিই আদিম সান্টানাকে পুনর্জন্ম দিয়েছেন। জাতে ওঠা এখনকার বহু শিল্পী - মাইকেল জ্যাকসন, স্টিভেন টাইলার, রব থমাস থেকে শুরু করে ‘নিকেলব্যাক’-এর শ্যাড ক্রোগার, ‘লিনকিন পাকর্’-এর চেস্টার বেনিংটন মায় শাকিরা অবধি সবার সঙ্গেই সান্টানা কোলাবোরেট করেছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অন্যের গানকে কমপ্লিমেন্ট করেছেন তাঁর গিটারের মাধ্যমে। এ পর্যায়ে সবচেয়ে বড় দুটি হিটে সম্পূর্ণ দু’রকম তাঁর উপস্থিতি। ‘স্মুদ’ গানে যেমন টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছেন প্রত্যেকটি লাইনে, ‘মারিয়া মারিয়া’-তে আবার তাঁর সোলোর জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতে হয়। অর্থাৎ সান্টানা জানেন, কোথায় কী ভাবে ব্যবহার করতে হয় তাঁর গিটার, কখন কোন শিল্পীর কোন গানে জোট বাঁধলে আসবে অর্থ, থাকবে বাজার। অর্থ আর বাজারের কথা উঠলই যখন, আসুন পাঁচ নম্বর সান্টানার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এই সান্টানা দুস্থদের জন্য জনকল্যাণ ভাবনায় তৈরি করেন ‘মিলাগ্রো ফাউন্ডেশন’। এই সান্টানা অসাম্যের বিরুদ্ধে। এই সান্টানা স্বাস্থ্য, শিক্ষার মন্ত্রকে হাতিয়ার করেন। গান, গিটারের মাঝখানে চোখ বুজে ফেলেন, কথ্য ভাষায় গেয়ে ওঠেন প্রোটেস্ট র্যাপ। বলেন, আমি বিশ্বাস করি আমি তুমি বদলে দিতে পারি এই মন, এই শহর, এই দেশ, আর এই বিশ্ব। কারণ, আমরাই আসল, আমরা একটাই ফ্যামিলি, আমরাই আলো, আমরাই ভালবাসা। হ্যাঁ, এই সান্টানাকে আমি বেঙ্গালুরুর কনসার্টে দেখেছি।
ইয়ে হাত মুঝে দে দে ঠাকুর ...
সান্টানার বাজনা শুনে, তাঁর আনএন্ডিং ‘ওয়ান নোট সাসটেন’-এর প্রায় ম্যাজিক সদৃশ কেরামতি দেখে কত লক্ষ গিটারিস্ট যে মনে মনে এ কথা বলেছেন! কিন্তু সান্টানা তো সত্যিই নিজের হাত খুলে দিতে পারেন না! তবু কিছু নিশ্চয়ই দিয়ে গেলেন তিনি!
ফসিল্স-এর বেসিস্ট চন্দ্র ছিলেন সান্টানা কনসার্টে। চন্দ্রর মতে, স্টেজ আর পাবলিক অ্যাড্রেস সেটআপ কী ভাবে করছেন আন্তর্জাতিক তারকারা এবং কী ভাবে তার থেকে রেজাল্ট পাচ্ছেন, সেটা হাতে-কলমে দেখার এটাই সুযোগ। যদিও চন্দ্র সেদিনের সাউন্ড প্রোডাকশন নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। তবু আরেকটা কথা বললেন তিনি, ‘‘আন্তর্জাতিক সঙ্গীতশিল্পীরা যত এদেশে আসবেন, আমাদের মিউজিক তাঁরা তত জানবেন, খোঁজ পাবেন, হয়তো ভারতীয় শিল্পীদের আন্তর্জাতিক কোলাবরেশনের পথ আরও কিছুটা সুগম হবে।’’
আমার কাছে অবশ্য সান্টানা নিয়ে এলেন উন্মুক্ততার আহ্বান। মিউজিক যখন পারফর্মিং আর্ট, তখন তার একটা স্ট্রাকচার্ড উপস্থিতি থাকে। কিন্তু ষাটের দশকের যে সময়টা রক মুভমেন্ট তৈরি হয়েছিল, সেই সময়ের সঙ্গীতকাররা ছক ভাঙার স্বপ্ন দেখতেন। আধুনিক সঙ্গীতে তাই নিজেকে যতই প্রমাণিত করুন না কেন, সান্টানা আমার কাছে এমন একজন শিল্পী, রক মিউজিকের শিকড় যিনি শরীরে, চেতনায় লালন করছেন। তাঁকে দেখে, তাঁর গিটারের কণ্ঠস্বর শুনে আশ্বস্ত হলাম।হ্যাঁ, আমরাই পারি রক সঙ্গীতকে ক্রমশ ছকবদ্ধ হওয়া থেকে বাঁচাতে।
আমরাই পারি টেকনোলজির নামে রকের আত্মার টূঁটি টিপে ধরা থেকে তাকে মুক্তি দিতে। মুক্ত হোক রক। সে ভেঙে দিক বাঁধাধরা সময়ের শাসন। মানুষের জন্য, মানুষের স্বার্থে, মানুষেরই অংশগ্রহণে... কনসার্ট দীর্ঘজীবী হোক।
|