|
|
|
|
|
|
উত্তর কলকাতা |
পাল্টে যাওয়া ছবি |
সবুজ স্বপ্নের ফেরিওয়ালা |
জয়তী রাহা |
চল্লিশ বছরের পরিশ্রম!
তাতে মেওয়া না হলেও ফলছে আম, জাম, কাঁঠাল, জামরুল, আতা, কমলা, বাতাবি, করমচা, আমড়া, বাক্সবাদাম, কামরাঙা আরও কত কী! এ বাগানে প্রবেশ অবাধ। ছোটরাও খুশিতে ডগমগ। গাছ থেকে ফল-ফুল পাড়া, গাছে চড়া কোনও কিছুতেই যে নিষেধ নেই। আর বাগানের মালী? তিনি তো বেজায় খুশি। তাঁর কথায়: “ওদের দেখলে নিজের ছোটবেলাটা ফিরে পাই। এ বাগানের শুধু একটাই নিয়ম। গাছের কোনও কিছু কেউ বিক্রি করতে পারবে না।”
বছর চল্লিশ আগের কথা। খড়দহ খালের দু’পাড়ের চেহারা তখন জল-জঙ্গলে ভরা। খালের এক দিক পানিহাটি পুর এলাকার অধীন। অন্য দিক খড়দহ পুর এলাকার। ধীরে ধীরে খালপাড়ের কাঁচা রাস্তার ভাঙন শুরু হয়েছিল। খালধারের ষোলো ফুট রাস্তার ধারেই বাড়ি ছিল তাঁর। বাড়ি ভাঙার চাপা আশঙ্কা মনে চেপে বসে। যদিও এই ছবি কলকাতা শহরের অন্যান্য খালপাড় থেকে আলাদা কিছু নয়।
|
|
পরিস্থিতি বদলের আশায় বঞ্চিত বাসিন্দারা অবশেষে জনমত গঠন করে সরকারি স্তরে খাল সংস্কার, রাস্তা সারাইয়ের জন্য আবেদন করবেন। দীর্ঘ দিন লাল ফিঁতের ফাঁসে আটকে থাকবে সেই আবেদন। এই পর্যন্ত দৃশ্যটা পরিচিত। সরকারি স্তরের ঢিলেমিতে বোধহয় ভরসা ছিল না অনিমেষ ঘোষের। সত্তরের দশকের শুরুতে কেন্দ্রীয় সরকার ‘সমাজভিত্তিক বনসৃজন প্রকল্প’র কাজ শুরু করে। তার থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু এলাকার বাসিন্দা অনিমেষবাবুর এই বনসৃজনের চিন্তা।
সকাল হলেই বেরিয়ে পড়েন চারা, কোদাল হাতে। সযত্নে পুঁতে দেন চারাগাছ, ঘিরে দেন বেড়া দিয়ে। চলতে থাকে নিয়মিত সেবাযত্ন। আজও সত্তরোর্ধ্ব অনিমেষবাবু একই ভাবে কাজ করে চলেছেন, সঙ্গী এক জনকে নিয়ে। এর পরে গাছের গায়ে সেঁটে দেন নেমপ্লেট। চারা পোঁতার আগে নিজের বাড়িতে টবে রেখে কিছু দিন চলে গাছের পরিচর্যা। এ ভাবে গত চল্লিশ বছরে প্রকৃতির ভাঁড়ারে যোগ হয়েছে বাসক, অর্জুন, আমলকী, বহড়া, নিম, ঘোড়ানিম, রোশনলতা, অশোক, সেগুন, শিশু, শিরীষ, জারুল, সুন্দরী, গামার, যজ্ঞডুমুর, জারুল, বকফুল, সজনে, ছাতিম, ফুরুস, রক্তকরবী, মহুয়া-সহ আরও অনেক। সবটাই নিজের উদ্যোগে।
এলাকার প্রায় ষাট বছরের বাসিন্দা চন্দন দেবের কথায়: “গত চল্লিশ বছর ধরে নিঃশব্দে এলাকায় সবুজ বিপ্লব ঘটিয়েছেন অনিমেষবাবু। শুধু খালপাড়ই নয়, আশপাশের পুকুরপাড় কিংবা কল্যাণনগরের সামনের ওল্ড ক্যালকাটা রোডের দু’পাশের রাস্তায়ও বসেছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। পুকুর ধারে, গাছের আশপাশে ফ্লেক্সে লিখে দেন পরিবেশ পরিচ্ছন্নতার বিভিন্ন স্লোগান। সবটাই নিজের খরচ আর পরিশ্রমে।” এলাকারই গৃহবধূ সোমা ভৌমিক বলেন, “২৬ বছর আগের খালপাড়ের ছবির থেকে এখনকার অনেক পার্থক্য। তখন দেখতাম পাড়ের ভাঙন। গাছ না থাকলে হয়তো এত দিনে পাড় ভাঙতে ভাঙতে বাড়িগুলোই তলিয়ে যেত। গাছের শিকড়ের টানে আটকেছিল পাড়ের ভাঙন। খালধার দিয়ে গাছের ছায়ায় হাঁটতে বেশ লাগে। খালপাড়। অথচ দুর্গন্ধের নামমাত্র নেই এখানে। পড়াশোনার জন্য কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যেমন আসেন, দিদিমণির হাত ধরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও আসে গাছ, ফুল-ফল চিনতে।” |
|
বিষয়টিকে উৎসাহের সঙ্গে দেখছে সেচ দফতরও। মেট্রোপলিটন ড্রেনেজ ডিভিশন-২-এর এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার সোমনাথ দেব বলেন, “কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বাগজোলা খাল সংস্কার শুরু হয়েছে। কিন্তু এলাকার জন-সচেতনতা না থাকাটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে অনিমেষবাবুর মতো নাগরিকদের প্রয়োজন খুব বেশি। আম্তরিকতার সঙ্গে সাধারণ মানুষ এগিয়ে এলে যে কাজ হয় এটা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই ভাবে অনিমেষবাবুর মতো অনেক নাগরিক এগিয়ে আসুন তাঁদের প্রস্তাব নিয়ে। এর জন্য যথাসম্ভব সাহায্যে প্রস্তুত সেচ দফতর।”
ছেলেবেলা থেকেই গাছের শখ ছিল অনিমেষ ঘোষের। সেই শখ যে ডালপালা মেলে মহীরূহের চেহারা নেবে, তা কি আগে বুঝেছিলেন তিনি? প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেন না অনিমেষবাবু। স্মিত হেসে ফলসাগাছের গায়ে হাত বোলাতে থাকেন সত্তরোর্ধ্ব যুবক! |
|
|
|
|
|