ভারতীয় ক্রিকেটে নির্বাচন ব্যাপারটা হল লটারির মতো। দশকের পর দশক ধরে এ দেশে দল বাছার কাজটা হয়ে এসেছে কোনও ক্রিকেটীয় যুক্তি মেনে নয়, স্রেফ ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে। আর তার থেকেও খারাপ ব্যাপার হল, নির্লজ্জ ভাবে যুক্তি তর্ক সাজিয়ে এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলোকে মান্যতা দেওয়া চলছে।
এই তো সে দিন সিসিআইতে বেশ কয়েক জন প্রাক্তন ক্রিকেটার জড়ো হয়েছিলেন ভারত ‘এ’-র খেলা দেখতে। আলোচনা চলছিল ভারতীয় দলের বিভিন্ন দিক, শক্তি-দুর্বলতা সব নিয়েই। সেই আড্ডায় সবার মুখে একটাই প্রশ্ন কমন ছিল; সুরেশ রায়না কী করে দলে ঢোকে আর মনোজ তিওয়ারি কী এমন দোষ করেছে যাতে অধিনায়কের গুড বুকে ওর নামের উপর ঢেঁড়া পড়েছে?
তিওয়ারি এমন একটা পরিস্থিতিতে ব্যাট করতে নামল যখন দল বেশ টলমল অবস্থায়। সমুদ্রে জোয়ার আসার সঙ্গে সঙ্গে দুপুর দু’টোর পর থেকে ব্রেবোর্নে যে হাওয়াটা বইতে থাকে তার সাহায্য নিয়ে ইংল্যান্ডের বোলাররা তখন বল দারুণ মুভ করাচ্ছে। সেই বোলিংয়ের সামনে রায়না দেখলাম পুরোপুরি বেকুব বনে গিয়েছে! কী যে হচ্ছে সেটা ও ধরতেই পারছিল না। তিওয়ারি কিন্তু নামার পর আগে পরিস্থিতিটা সুন্দর ভাবে মাপল। উইকেটের গতি বোঝার জন্য যে ভাবে কয়েকটা বল দেখে নিল তাতে আমাদের সেই পুরনো আপ্তবাক্যটা মনে পড়ে যাচ্ছিল ফাস্ট বোলারকে খেলতে গিয়ে প্রথমের দিকে তুমি যত বেশি বল ছাড়বে, তোমার টিকে থাকার সম্ভাবনা ততই উজ্জ্বল হবে। তিওয়ারি এর সঙ্গে বুদ্ধি করে স্ট্রাইকটাও রোটেট করিয়ে গেল।
আগে তিওয়ারিকে শর্ট বল খেলতে গিয়ে সর্বদা সমস্যায় পড়তে দেখেছি। এ বার দেখলাম, ছেলেটা ওই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে খেটেছে। শর্ট বল বা পেসারের চতুর্থ স্টাম্পে পড়া ডেলিভারি তাড়া করতে এক বারও ছুটল না। কভার অঞ্চলটা ফাঁকা রেখে ড্রাইভ মারার লোভ দেখিয়ে ওর জন্য তিন স্লিপ রেখে ফাঁদ পেতেছিল ইংল্যান্ড। তিওয়ারি কিন্তু ড্রাইভ মারার লোভটা পুরোপুরি সামলে অফ স্টাম্পের বাইরের বল এবং শর্ট বলগুলো ছেড়ে গেল। খুব খুঁটিয়ে দেখলে, ও ব্যাটটা শরীরের খুব কাছে রেখে খেলছিল। তার সঙ্গে ‘ব্যাক অ্যান্ড অ্যাক্রস’ খেলছিল, টেকনিকের যে ব্যাপারটা ব্যাটসম্যানরা আজকাল প্রায় ভুলতে বসেছে।
অ্যান্ডারসনকে খেলার সময় তিওয়ারি মিড-অফের ডান দিকে ড্রাইভ করছিল। কিন্তু ডিফেন্স করতে গিয়ে এক-এক সময় ওর ব্যাটের সুইং চলে যাচ্ছিল কভারের দিকে। অ্যান্ডারসন ওকে বিট করার পরে ভুলটা ধরতে পারে। মনে মনে ব্যাপারটা নোট করে নিয়েছিল বলেই মনে হয়। কারণ, চা-বিরতির পরে যখন নামল তখন ওর ব্যাটিংয়ের সংশোধিত সংস্করণে দেখলাম ওই ভুলটা আর হচ্ছে না। গ্রেম সোয়ান যথেষ্ট ধূর্ত অফ স্পিনার। রায়নার জীবন বেহাল করে ছাড়ল। নিজের বৈচিত্রের ভাঁড়ার থেকে নানা অস্ত্র বের করে তিওয়ারিকেও পরীক্ষার মুখে ফেলার চেষ্টা করে গেল সোয়ান। তিওয়ারি কিন্তু যখন প্রয়োজন তখন একদম নরম হাতে খেলে বলেই স্পিন নির্বিষ করে দিল। ১৯৭৪-এর বেঙ্গালুরু টেস্টে কালীচরণকে ঠিক এ ভাবেই ভারতীয় স্পিনারদের সামলাতে দেখেছিলাম।
আশা করি সে দিন সিসিআই-তে হাজির থাকা সাংবাদিকরা বুঝতে পেরেছেন যে, ভারতীয় ব্যাটিংয়ের ছ’নম্বর জায়গাটার দাবিদার হিসেবে যুবরাজের সঙ্গে রায়নার তুলনা করাটা কত বড় মূর্খামি! তবে ভারতীয় দলের পাঁচ বা ছ’নম্বর ব্যাট যদি সত্যিই ফর্ম হারিয়ে বসে, তবে তিওয়ারি ছ’নম্বরের জন্য একেবারে আদর্শ। টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে রায়নার নামটা আলোচনাতেই আসা উচিত নয়। ওর মতো ব্যাটসম্যানদের সম্পর্কে বিজয় মঞ্জরেকর একটা কথা বলতেন, ‘তৃতীয় শ্রেণির টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় শ্রেণির বোলিংয়ের বিরুদ্ধে প্রথম শ্রেণির ব্যাটসম্যান।’
মনোজ তিওয়ারি কিন্তু সে দিন পরিস্থিতির মোকাবিলায় নামার আগে পারিপার্শ্বিকটা যে ভাবে বুঝে নিল, সেটাই বলছে টেস্ট ক্রিকেটের মানসিকতা আর টেকনিক, দু’টোই ওর আছে। তিওয়ারির ওই পরিণত ব্যাটিং দেখার পরেও যদি পাঁচ জন বিজ্ঞ মানুষের মধ্যে চার জন প্রভাবিত না হয়ে থাকেন, তবে বলতেই হচ্ছে তাঁরা সে দিন অন্য কোনও জিনিস দেখছিলেন, তিওয়ারির ব্যাটিং নয়।
ওর ভেতর আর খুব বেশি ক্রিকেট বাকি নেই বলে তেন্ডুলকর নিজেই স্বীকার করেছে। এই অবস্থায় তিওয়ারিকে হিসেবের মধ্যে রেখেই ভারতীয় দলের টেস্ট ম্যাচের কৌশল ছকতে বসা উচিত। ব্রেবোর্নে ক্রিকেটের প্রকৃত সমঝদারদের তারিফ কুড়িয়েছে ছেলেটা। ওর এ বার পাকাপাকি ভারতীয় দলের এক জন হয়ে ওঠার সময় এসেছে। রায়নার মতো যারা, তারা থাক না টি-টোয়েন্টি নামের চাড্ডি-বানিয়ান ক্রিকেটের জন্য! |