|
|
|
|
শান্তিনিকেতনের ছায়ায় প্রকৃতির কোলে বসে স্কুল |
সুমন ঘোষ • গোদাপিয়াশাল |
এখনও নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে নীলকুঠিটা। জঙ্গলমহলও সাক্ষী অনেক নাশকতা-খুন-জখমের। সেই সব যন্ত্রণার স্মৃতি সঙ্গে নিয়েই গাছতলায় ক্লাস করে জঙ্গলমহলের গোদাপিয়াশাল মহাত্মা গাঁধী স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির সঙ্গে ছাত্রদের একাত্ম করতে গাছতলায় পড়ানোর যে রেওয়াজ শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সে ভাবধারাতেই এগোচ্ছে এই স্কুল। ক্লাসঘর থাকলেও গাছতলায় পড়া চলছে গাছতলাতেই। স্কুলের জন্মের কথা উঠতেই শিক্ষক তথা স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে পড়ে যায় পুরনো ইতিহাস। গরিব মানুষকে নীলচাষে বাধ্য করানো, অবাধ্য হলেই চাবুকের ঘা পড়ত তখন। এলাকায় পড়াশোনার ব্যবস্থা বলতে ছিল এম ই স্কুল, যেখানে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হত। তারপর যেতে হত শালবনি বা কেশপুরের আনন্দপুর। গরিব বাড়ির ছেলেরা দীর্ঘ পথ হেঁটে সেই স্কুলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেত না। সমস্যা সমাধানে সাহায্য উদ্যোগী হন তৎকালীন নীলকুঠির ইংরেজ ম্যানেজার এইচ বি গ্রাহাম ফ্লেমিং। ১৯৪৮ সালে এম ই স্কুলে চালু হয় সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পঠনপাঠন। ক্রমে দিন বদলায়। ১৯৬৬ সালে কাছারি বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয় এম ই স্কুল। সেই স্কুলই এখন গোদাপিয়াশাল মহাত্মা গাঁধী স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে রয়েছে ২২ একর জমি, রয়েছে প্রচুর গাছ। তারই ফাঁকে ফাঁকে ক্লাসরুম। বর্ষাকালে বা যে সব ক্লাসে বেশি ব্ল্যাকবোর্ড ব্যবহৃত হয় সেই সব ক্লাস ছাড়া বাকি প্রায় সবই খোলা আকাশের নীচে হয়। |
|
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ। |
১৯৬৮ সালে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক বিমলাপ্রসন্ন মজুমদার রবীন্দ্র ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে রীতি চালু করেছিলেন, তা এখনও চলছে। তবে আগে সকলেই মাটিতে বসলেও এখন গাছের তলায় সিমেন্টের বেদি তৈরি করা হয়েছে ছাত্রদের জন্য। সামনে চেয়ার নিয়ে বসেন শিক্ষক। স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রণব সিংহ থেকে প্রাক্তন সম্পাদক গৌরাঙ্গ বন্দ্যোপাধ্যায়, বর্তমান সভাপতি দেবনারায়ণ মাসান্ত সকলেরই অভিমত এক, “প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেলে মন ও শরীর ভাল থাকে। পড়াশোনার চাপ তখন আর বোঝা হয়ে দাঁড়ায় না। শিক্ষক ও ছাত্র-সকলেই থাকেন প্রাণবন্ত।” নবম শ্রেণির অপূর্ব সিংহ, দশম শ্রেণির সচ্চিদানন্দ মাসান্তদের কথায়, “ভীষণ ভাল লাগে। ক্লাসরুম তো বদ্ধ একটা জায়গা। আলো কম, হাওয়া ঢোকে না। বাইরে প্রকৃতির আলো, বাতাস, গাছের ছায়া— সব মিলিয়ে এক অন্য রকম অনুভূতি।” তবে স্কুলের পরিবেশের ক্রীড়া শিক্ষক সুকুমার দাস ও ইতিহাসের শিক্ষক শুভেন্দু রায় বলেন, “স্কুলের পরিবেশ সত্যিই অতুলনীয়। কিন্তু কিছু সমস্যাও রয়েছে।” স্কুল-কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ২২ একর জমিটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা নয়। ফলে অবাধে ঢুকে পড়ে গরু, ছাগল। পাশাপাশি রাতে অসামাজিক কার্যকলাপও ঘটে। সম্প্রতি স্কুলেরই ঝোপ থেকে কিছু কার্তুজও মেলে। আবার অনেকে বেআইনি ভাবে দখলেরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্কুলের মধ্যেই আদিবাসী ছাত্রবাস হওয়ায় কখনও কখনও খুদে ছাত্রদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, স্কুলটি যাতে অবহেলিত না হয়। হেরিটেজের মর্যাদা পেলে সরকারি সাহায্য মিলবে। নীলকরদের অত্যাচার ছাপিয়ে রাবীন্দ্রিক ভাবনার স্কুল ফিরে পাবে নিজের ঐতিহ্য। |
|
|
|
|
|