কম দিন তো হল না। দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে সত্তরটি বছর। কিন্তু এত দিনে ভুল করেও কেউ একবারটি হাত দিল না ফায়ারপ্লেসটায়। গজগজ করতে করতে বাড়ির মালিক ডেভিড মার্টিন এক দিন নিজেই হাত লাগালেন ফায়ারপ্লেসে। কিন্তু পরতে পরতে যে এত রহস্য তাঁর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে, কল্পনাও করেননি ওই প্রবীণ।
দু’ডানায় ভর করে সেই কখন থেকে সে উড়েই চলেছে। ছোট্ট একটা পায়রা। আকারে ছোট তো কী হয়েছে, তার কাঁধে, থুড়ি পায়ে, রয়েছে গুরুদায়িত্ব। তার দিয়ে বাঁধা এক সাঙ্কেতিক বার্তা। শত্রু ঘাঁটির গোপন খবর পৌঁছে দিতে হবে দেশের সৈন্যদের কাছে। তাই ফুরসত নেই তার। পথ তো কম নয়।
মাইলের পর মাইল পার করে ক্লান্ত পায়রাটি হয়তো বসে পড়ে দু’দণ্ড জিরোতে। কিন্তু ডালের নীচে ওঁৎ পেতে ছিল সাক্ষাৎ বিপদ ফায়ারপ্লেসের মুখ খোলা চিমনি। উড়ান শেষের আগেই ডাল ভেঙে, চিমনির আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যায় তার ছোট্ট দেহ। সত্তর বছর পর, দক্ষিণ পূর্ব ইংল্যান্ডের সারের বাড়ি থেকে আগুনে পোড়া সেই কঙ্কালটা উদ্ধার করেছেন ৭৪ বছর বয়সী ডেভিড মার্টিন। |
ফারারপ্লেস থেকে পাওয়া পায়রার কঙ্কাল হাতে ডেভিড মার্টিন।
|
প্রথমে ভেবেছিলেন আর পাঁচটা সাধারণ পায়রার মতোই এটা একটা। ভুল ভাঙল একটু পরেই। পায়ের সঙ্গে অ্যালুমিনিয়ামের তার দিয়ে বাঁধা লাল রঙের ওটা কী? সিগারেটের কাগজের থেকেও পাতলা একটা কাগজে কী যেন লেখা! গোড়ায় খানিকটা হকচকিয়ে গিয়েছিলেন মার্টিন। পড়ে দেখলেন, সবকটার মধ্যেই কেমন যেন অদ্ভুত মিল রয়েছে। মোট চারটি সারি। প্রত্যেকটিতেই সাতটি করে শব্দ। শব্দ তো নয়, যেন কিছুর সঙ্কেত। তাদের প্রত্যেকটিতে আবার রয়েছে হয় পাঁচটি করে অক্ষর অথবা পাঁচটি সংখ্যা। প্রেরকের নাম সার্জেন্ট ডব্লু স্টট।
খবরটা জানাতে আর দেরি করেননি মার্টিন। তাঁর পাওয়া ওই সঙ্কেতের গভীর ধাঁধা নিয়ে এখন মাথা ঘামাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইতিহাসবিদদের ধারণা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের যে অংশ নাৎসিদের দখলে ছিল, সেখান থেকে রেইগেটে মিত্রবাহিনীর ডেরার উদ্দেশে পাঠানো হয়েছিল ওই পায়রাটিকে। খুব সম্ভবত সেটা ছিল ১৯৪৪-এর জুন মাস।
দূত হিসাবে পায়রার ব্যবহার রীতিমতো চালু ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই। গত শতকের চল্লিশের দশকে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজল, তাদের পুরনো কাজ আরও এক বার ফিরে পেল পায়রারা।
অক্ষশক্তি বা মিত্রপক্ষ, পায়রাকে কাজে লাগাতে পিছিয়ে ছিল না কেউই। শুধু ব্রিটিশ বায়ুসেনার প্রশিক্ষিত পায়রার সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ৫০ হাজার। কেবল প্রশিক্ষণই নয়, ভাল কাজ করলে মিলত পুরস্কারও। সেনাবাহিনীতে যেমন ভিক্টোরিয়া ক্রস সম্মান, এদের তেমনই দেওয়া হতো ডিকেন মেডেল। এমনকী জানা যায়, সে সময় অন্তত বত্রিশটা পায়রার ভাগ্যে জুটেছিল এই মেডেল। |
পাখিটির পায়ে বাঁধা সাঙ্কেতিক বার্তাবাহী রেড ক্যাপসুল।
|
বিশ্বযুদ্ধের সময়ের এই সব পায়রাদের নিয়েই ব্লেচলে পার্কে গড়ে উঠেছে একটি সংগ্রহশালা। তার কিউরেটর কলিন হিলের মতে, মার্টিন যে লেখাটি পেয়েছেন তাতে সম্ভবত ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ কোনও খবর ছিল। যে লাল ক্যাপসুলের মধ্যে কাগজটি ঢোকানো ছিল, তা সাধারণত ব্যবহার করা হতো বিপক্ষের সীমানায় বোমা ফেলার মতো গোপন নির্দেশ পাঠাতে। তা ছাড়া, প্রাপকের নামেও যে সঙ্কেত (X02) ব্যবহার করা হয়েছে, তাতেও হয়তো রয়েছে একই ইঙ্গিত।
শুধু মার্টিনই নন, এই রহস্য উদ্ঘাটনের অপেক্ষাতে এখন দিন গুনছেন ইতিহাসবিদেরা। বলা যায় না, হয়তো ওই এক টুকরো কাগজই বদলে দিতে পারত ইতিহাসের গতি। |