উনিশ শতকে যে আধুনিক বাংলাসাহিত্য গড়ে উঠেছিল তার মুখ্য ধারার নির্মাতারা অধিকাংশই পেশায় ছিলেন ভাল চাকুরে। বঙ্কিম, দীনবন্ধু, রমেশচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রঙ্গলাল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, পোস্টাল বিভাগের বড়কর্মী, প্রশাসনিক কর্মী, আইনজীবী এই সব। তাঁদের জীবনে নিরাপত্তা ও প্রতিষ্ঠা ছিল যথেষ্ট। সাহিত্যসেবা তাঁদের কাছে যতটা দেশসেবা বা জাতিপরিচয় নির্মাণের রসদ, ততটা আত্মপরিচয় গড়ার পাঞ্জা নয়।
বিশ শতকে, বিশ্বযুদ্ধের পর এক দল তরুণ সাহিত্যিক এলেন। তাঁদের তখন কল্লোল যুগের অচিন্ত্য সেনগুপ্তর ভাষায় এক জনের একা একটা পুরো সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ‘কাঁচি এবং আরও কাঁচি।’ এই সাহিত্যিক বন্ধুদের মধ্যে শৈলজানন্দ খোলার বস্তিতে থেকেছেন, ভবানীপুরে পানের দোকান দিয়েছেন। প্রেমেন্দ্র ওষুধের বিজ্ঞাপন লিখেছেন, নৃপেন্দ্র টিউশানি করেছেন, অন্য-অন্যরা টাকার জন্য লেখার নামে ‘উঞ্ছবৃত্তি’ করেছেন বায়োস্কোপের টাইটেল তর্জমা থেকে রাজামহারাজার নামে গল্প লিখে দেওয়া, সভাপতির অভিভাষণ লিখে দেওয়া, এই সব। স্বপ্ন একটা ছিল: রবীন্দ্রনাথের থেকে অন্য রকম সাহিত্য রচনার স্বপ্ন। স্বভাবতই এই দলের সঙ্গে উনিশ শতকের ভাল চাকরি করা সাহিত্যজীবীদের জীবনযাত্রার কোনও মিল নেই। এঁরা সাহিত্যের মধ্যে স্বভাবতই নিজেদের জীবনযাত্রার মেজাজ ও মর্জি খানিক চালান করতে চেয়েছিলেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই পালটে যাওয়া সময়ের সন্তান। তাঁর জন্ম ও পার বাংলায়, কর্মজীবন এ পারের কলকাতায়। কলকাতার বাঙালি ও পার থেকে চলে আসা চালচুলোহারাদের সাদরে গ্রহণ করেছিলেন তা তো নয়। উদ্বাস্তুদের জীবন ও সাহিত্যের মিল দেখানো কঠোর সমালোচকের কথা সুনীল তাঁর পদ্যে লিখেওছিলেন: ‘যে উদ্বাস্তু, তার আবার কী মাটির টান হে?/ চশমা-আঁটা সমালোচক এই তো সেদিন বলে দিলেন/ পায়ের তলায় মাটি নেই তো, তাই তো ওরা/ ছন্নছাড়া অবিশ্বাসী!’ ষাটের দশকে স্বাধীন দেশে শিক্ষিত বাঙালি যুবক অনিশ্চয়তা ও অর্থসংকটের মধ্যেই তাঁদের আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে চাইছিলেন, বলতে চাইছিলেন নিজেদের কথা। আর সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা ও আত্মজৈবনিক উপন্যাস হয়ে উঠছিল তাঁদের আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়। নীরদ মজুমদারের বাড়িতে। |
স্বাধীন এবং ভাঙা স্বদেশে সাহিত্যই সুনীলের দাঁড়ানোর খড়কুটো। তিনি ১৯৫৪’র গ্র্যাজুয়েট। পঞ্চাশের দশকে চাকরি পাওয়া শক্ত। সুনীল ক্রমে লেখাকে তাঁর জীবিকা করেন ‘আমায় বাঁচতে তো হবে! আমায় ভাইবোনদের খাওয়াতে তো হবে! তখন লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম।’ সুনীল এই প্রয়োজনটাকে সময়ের আর একটা চাহিদার সঙ্গে মেলাতে পেরেছিলেন। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ থেকে বুদ্ধদেব, এঁরা কেউ সাহিত্যকে সাংস্কৃতিক পণ্য বলে মনে করেননি। সুনীল করেছিলেন। তাঁর কবিতায় ‘মসীপণ্য’ শব্দটি যেমন আছে, তেমনি হালকা কৌতুক করেই লিখেছিলেন, ‘একটা কবিতা লিখে আমি একটা রাজপ্রাসাদ বানাবো/ এবার কবিতা লিখে আমি চাই পনটিয়াক গাড়ি’। কবিতা লিখে না হোক, গদ্য লিখে সুনীল রোজগার করতে পেরেছিলেন।
তাঁকে সাহায্য করেছিল পালটে যাওয়া সময়, সমাজ, অর্থনীতি। দেশের জন্য সাহিত্য, দেশ জাগানোর জন্য সাহিত্য, এ-সব আর প্রবল নয়। ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি স্বাধীন দেশে সমর্থ হয়ে উঠছে, তারা গপ্পো-উপন্যাসকে বিনোদন সামগ্রী হিসেবে কিনে পড়তে চায়। নিজেদের অবস্থা আর অবস্থানের সঙ্গে গপ্পো-উপন্যাসের মেজাজ-মর্জির মিল দেখলে ক্রেতারা খুশি। এই চাহিদাটা খেয়াল করে সাহিত্য উৎপাদন ও বিপণনের কৌশল বদলাল। বৃহদায়তন নভেল নয়, চটি উপন্যাস। সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান সাংস্কৃতিক পণ্য নির্মাণের দায়িত্ব নিল। এক ধাক্কায় সে সব লেখা কাগজের পাতায়, পুজোসংখ্যায় বা, পরে, বই আকারে কিনে শুয়ে বসে পড়া যায়। সুনীলের বেশির ভাগ গপ্পো উপন্যাসে সেটা সম্ভব হত। আবার মধ্যবিত্ত বাঙালির রোমান্টিক বিপ্লবের স্বপ্ন খানিকটা মিলে যেত নীললোহিতের বচনের সঙ্গে। অন্য দিকে মধ্যবিত্ত বাঙালি যাতে ইতিহাসের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন, সে জন্য হালকা চালেই লেখেন আমিই সে, সেই সময়, প্রথম আলোর, মনের মানুষ-এর মতো ইতিহাসের উপাদান মেশানো নভেল। ইতিহাসের পাতাতেও যেন বাঙালি মধ্যবিত্ত নিজেকে চিনতে পারেন।
সুনীল নব্বইয়ের দশকের আগেই সুনীল হয়ে গিয়েছিলেন। ওই দশকটি থেকে খোলা অর্থনীতি বাঙালির সামনে বিনোদনের অন্যান্য পথ খুলে দিলেও নভেল নামের কাটতিযোগ্য পণ্যটি নির্মাণে সুনীল তখনও অনলস। বিনোদনের অন্য মাধ্যমের আবির্ভাবের পরেও তাঁর জনপ্রিয়তায় টান পড়েনি। লালনকে নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘মনের মানুষ’ তার প্রমাণ। আর এখানেই তাঁর জয়। সুনীল মহৎ সাহিত্য রচনা করেছিলেন কি না তা তো পরবর্তী কাল বিচার করবে। তিনি যে প্রচুর লেখালিখি করে ক্রয়ক্ষমতাযোগ্য বাঙালিকে উপন্যাস কিনিয়েছিলেন, এটার অন্য একটা মানে আছে। বাংলা ভাষা ও বাঙালিকে তার স্বপরিচয়ে যদি টিকে থাকতে হয়, তা হলে বাংলা সাংস্কৃতিক পণ্যের চাহিদাকে জিইয়ে রাখতে হবে। হাতে গোনা ‘গ্রেট বাংলা সাহিত্য’ দিয়ে তা হবে না, প্রচারমূলক অক্ষম সাহিত্য দিয়েও তা হওয়ার নয়, সুনীলের ভাষায় ‘অক্ষম রচনা শেষ পর্যন্ত শ্রমিকশ্রেণিকেও উদ্বুদ্ধ করে না, শিল্পও হয় না।’ আর পরীক্ষামূলক উপন্যাস লিখলে যে বাঙালি পাঠক মুখ ফেরান তার প্রমাণ সুনীলের সবচেয়ে কম-বিক্রি হওয়া নভেল শক্ত অভিযান। এর মানে এই নয় যে অন্য ধারার লেখকরা ফালতু। কথাটা কেবল এই যে, বাংলা ভাষায় সুনীলের প্রচুর বই বিক্রি হওয়া শুধু বাণিজ্যের পক্ষে ভাল নয়, সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠার জন্যও জরুরি।
কাজটা করা খুব সহজ নয়। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী উচ্চমানের সাহিত্যিক ছিলেন সন্দেহ নেই, তবে তাঁর বই তো বিমল মিত্রের মতো বেস্টসেলার ছিল না। অভিমান করে এক বার সুনীলকে জ্যোতিরিন্দ্র বলেছিলেন, তিনি বিমল মিত্রের মতো বাংলা লিখবেন। সুনীল সাবধান করেছিলেন, এবং ঠিকই করেছিলেন। বিমল মিত্রের মতো লেখারও একটা ধাঁচ আছে, সেটা সবার হয় না। জ্যোতিরিন্দ্রের হয়নি।
সুনীল নিজের লেখা সম্বন্ধে প্রত্যয়ী ও আন্তরিক ছিলেন, কিন্তু মহৎ সাহিত্য বানাতে হবে বলে দমবন্ধ সিরিয়াসনেস আমদানি করেননি। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত বাঙালি তাঁর লেখা কয়েক দশক ধরে চেটেপুটে খেল, কিনল, কেনাল। দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, মহশিল্প ইত্যাদির সিরিয়াস ছাঁচ থেকে বাংলা গদ্যকে বের করে এনে যে অনায়াস লেখালিখিতে তিনি বাঙালিকে ভরিয়ে রাখলেন, অনেকটা তার মধ্য দিয়েই সত্তরের দশক থেকে ক্রমে এই একুশ শতক অবধি বাঙালি সাহিত্য কেনার ও পড়ার বাতিক বজায় রাখতে পারল। এটা কম কথা নয়।
|