|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
লাভক্ষতির অঙ্ক কষেননি, এখানেই তাঁর জয়
মঙ্গলবার ৬ নভেম্বর জয়ী হয়ে বারাক ওবামা দ্বিতীয় বারের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন কি না,
বলা শক্ত। কিন্তু ভোটের হারজিতের বাইরেও একটা অন্য হিসেব আছে। ইতিহাসের হিসেব।
সেমন্তী ঘোষ |
আগামী বুধবার ৭ নভেম্বর গোটা দুনিয়ার কাগজে ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট’ মিট রমনির ছবি বেরোবে, নাকি ওবামার পরিচিত মুখটিই আবার ছাপা হবে, দুটো সংখ্যার উপর সেটা ভীষণ ভাবে নির্ভর করছে। এই দুই সংখ্যা এখন ওবামাকে দুঃস্বপ্নের মতো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, আর রমনির হৃদয়ে আশালতা হয়ে তরতরিয়ে বাড়ছে। একটি হল ৪৯ শতাংশ। প্রেসিডেন্ট ওবামার গড় ‘পোল রেটিং’, নির্বাচনী পূর্বাভাসে তাঁর প্রতি সমর্থন। প্রসঙ্গত বলা দরকার, যে সব মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁদের প্রথম টার্মের শেষে ৫০ শতাংশ সমর্থন-রেখাটি পেরোতে পারেননি, তাঁদের কিন্তু একটি টার্মেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে, দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট হওয়া তাঁদের ভাগ্যে জোটেনি।
দ্বিতীয় সংখ্যাটি ৮.৩ শতাংশ মার্কিন বেকারত্বের সূচক। সে দেশের অর্থনীতির অবস্থা এমনই যে ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়া-ইস্তক মার্কিন বেকার-সংখ্যা শতাংশের হিসেবে কখনওই ৮-এর নীচে নামেনি। আমেরিকার পক্ষে এর চেয়ে খারাপ সময় তাদের সুদীর্ঘ তিনশো বছরের অভিজ্ঞতায় কমই ঘটেছে। প্রসঙ্গত এ ক্ষেত্রেও একটা কথা। মার্কিন ইতিহাসে প্রায় কোনও প্রেসিডেন্ট তাঁর প্রথম দফার শাসনকালে অর্থনীতির এত গভীর দুরবস্থা সত্ত্বেও দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। ‘প্রায়’ শব্দটি লক্ষণীয়। কেবল এক জন নেতাই পেরেছিলেন গভীর অর্থনৈতিক সংকটের মোকাবিলা করে দ্বিতীয় বার জিতে আসতে (১৯৩৬): ফ্র্যাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্ট। সংকটের তেমন মোকাবিলা ওবামার আমলে দেখা যায়নি, ফলে এফ-ডি-আর’এর সঙ্গে ওবামার তুলনাও মুশকিল।
এই সব দেখে শুনে বলা যায়, ওবামা যে এখনও প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে নিশ্চিত ভাবে পিছিয়ে নেই, সেটাই অনেক! তবে, পাশাপাশি আর একটা কথাও আছে বই কী। ওবামাকে সমর্থনের সংখ্যাটা পঞ্চাশ শতাংশ না ছাড়ালেও এই পঞ্চাশ কিন্তু বেশ উজ্জ্বল পঞ্চাশ। ওবামার সমর্থকরা প্রত্যয়ে ঝিকমিক করছেন, বলছেন: “This man will not fail.” বলছেন: “After all, Bin Laden is dead and GM’s alive!” এত আশাভঙ্গ, তার পরও এই ঝিকমিকানি? কোথাও এঁদের মধ্যে একটা আস্থা রয়েছে ওবামার প্রতি, চার বছর পরেও। কোথা থেকে আসছে সেই আস্থা? |
নেতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আয়ওয়া প্রদেশের একটি কলেজে
ছাত্রদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ওবামা। অক্টোবর ২০১২। ছবি: রয়টার্স |
এই আস্থা আসছে তাঁর কাজের ধরনটা থেকে, আদর্শ, সংকল্প আর জেদের মিশেলটা দেখে। এই ধরনটুকুর জন্যই ওবামার কিছু পদক্ষেপ যুগজয়ী হয়ে রইল বললে অত্যুক্তি হবে না। আগামী সপ্তাহে তিনি হারলেও, এমনকী প্রবল ভাবে হারলেও, কেবল এই জন্যই তাঁকে গত চার বছরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ব্যর্থ বলা যাবে না। তিনি যা করেছেন, জেনেবুঝে বিশ্বাসের ভরে করেছেন, রাজনীতির সাফল্য-ব্যর্থতার তোয়াক্কা করেননি, ভোটের লাভক্ষতির সংকীর্ণ হিসেব কষেননি। বহু সমালোচনা, গভীর সংকট সত্ত্বেও নিজের মতো ভেবেছেন, এগিয়েছেন। যেটা ঠিক বলে মনে করেছেন, রাজনৈতিক লাভ না হলেও সেটা করে গিয়েছেন, রাজনৈতিক ক্ষতি হলেও করেছেন। এক অর্থে এটা গোঁয়ার্তুমি। আবার অন্য অর্থে এক ধরনের রাজনীতি-দর্শন। ‘পরিবর্তন’-এর ধুয়ো তুলেই তো ২০০৮-এর নির্বাচনের জয় এসেছিল? পরিবর্তনটা আসলে তিনি এনে দিয়েছেন এই নেতৃত্বের মধ্যেই।
|
সংযত প্রত্যয় |
এই যেমন, মনে করা যাক ২০১০ সালের অগস্টে বিতর্কের তুফান তোলা একটা ঘটনা। নাইন-ইলেভন-এ নিউ ইয়র্ক শহরের ঠিক যে জায়গাটাতে উড়ন্ত বিমান এসে চুরমার করে দিয়েছিল টুইন টাওয়ারকে, সেই গ্রাউন্ড জিরো-য় একটি মসজিদ বানানোর দাবি তুলেছিলেন কয়েকটি মার্কিন মুসলিম সংগঠন। গ্রাউন্ড জিরোয় মসজিদ? যেখানে জঙ্গি মুসলিম হানার কদর্যতম ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে, সেখানেই আবার মসজিদ? একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? এমনই সব নিন্দার প্রবল ফুৎকার চার দিকে, এমন সময়ে প্রেসিডেন্ট ওবামার ঘোষণা: তাঁর কোনও আপত্তি নেই এই মসজিদ-নির্মাণের প্রস্তাবে। মুহূর্তে উত্তাল হয়ে উঠল ওয়াশিংটন ডি সি থেকে ক্যালিফোর্নিয়া। বলেন কী প্রেসিডেন্ট? এত অপমান মার্কিন মানুষকে? মুসলিমদের এত নির্লজ্জ তোষণ? অবস্থা দাঁড়াল এমনই, যে রাজনৈতিক চাপেও কোণঠাসা হোয়াইট হাউস। সঙ্গে তাল মিলিয়ে কুৎসার ব্যঙ্গরঙ্গ: আরে, নামটা মনে করো, বারাক ‘হুসেন’ ওবামা, নাম যখন মুসলিম কাজেও মুসলিম হবে.. আগেই বলেছিলাম..। কেউ গালি দিলেন, হুঁঃ, প্রফেসর এয়েছেন! কেউ বললেন, না না, সাক্ষাৎ ইমাম! ওবামা কিন্তু সংযত প্রত্যয়ের সঙ্গে উত্তর দিলেন। বললেন, ওই বিশেষ জায়গায় মসজিদ তৈরি উচিত না অনুচিত, তা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। কিন্তু এটা ঠিক যে ধর্মনিরপেক্ষতার অধিকার আমেরিকার সংবিধান-স্বীকৃত অধিকার, যে কোনও মূল্যে তা রক্ষা করতে হবে। বুঝিয়ে দিলেন, অন্য কোনও সম্প্রদায় সেখানে আরাধনাস্থল তৈরি করতে চাইলে যে ভাবে দেখতেন তিনি, মসজিদের ক্ষেত্রেও সে ভাবেই দেখবেন, অন্যথা হবে না। তাঁর সঙ্গী এক রাজনীতিক মন্তব্য করলেন: এ হল মার্কিন ধর্মনিরপেক্ষতার অগ্নিপরীক্ষা!
এই যে প্রত্যয়, কেবল ধর্মে নয়, রাজনীতিতেও বার বার তার ছাপ পড়েছে। ২০০৯ এপ্রিলে, প্রেসিডেন্ট ওবামার শততম দিবস পূরণ উপলক্ষে নানা বিশ্লেষণের মধ্যে একটি জরুরি মন্তব্য ছিল দ্য গার্ডিয়ান-এর সম্পাদকীয় স্তম্ভে। তারা বলে, এই নির্বিকারচিত্ত, ‘অ্যালুফ’, তারকাসুলভ মানুষটি আশ্চর্য মাপের নেতা, কারণ এই দিনটিতেই তিনি এক গুরুতর সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বুশের আমলে মার্কিন ফেডেরাল সরকারের কিছু ‘সিক্রেট মেমো’ প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত। কী ছিল এই নথিতে? সন্ত্রাসের অভিযোগে বন্দিদের উপর যে অমানবিক অত্যাচার চালায় ফেডেরাল সরকার, তার বিস্তারিত প্রমাণ। যদিও ঘটনাটা ঘটেছিল ওবামার পরাজিত-প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশের আমলেই, ওবামাও কিন্তু দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে পারেন না, কেননা ব্যাপারটায় সে দিন জড়িয়ে ছিল ফেডেরাল সরকারেরই নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, যা সরকার-নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রতীক। গোপন নথি প্রকাশ হওয়া মাত্র হইহই, মানবাধিকার সংস্থার অভিযোগ, মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে বিচার। অর্থাৎ, ব্যাপার দাঁড়াল, মার্কিন রাষ্ট্রের কুকর্ম ফাঁস করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজেই! বিপরীত যুক্তি দেওয়া সম্ভব যে, ওবামার এ কাজ না করে কোনও উপায় ছিল না, তথ্য শেষ অবধি ফাঁস হতই। কী হলে কী হত বলা মুশকিল, তবে তার পরই গুয়ান্তানামো বে-র জেলখানা বন্ধ করার যে দৃঢ় সংকল্প দেখা যায় তাঁর মধ্যে, যে ভাবে সে কাজ সাধিত হয়, তাতে পরিষ্কার, প্রশাসনিক স্বচ্ছতার কাজটা চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, মাঝপথে থামিয়ে দেননি।
সংকল্পের এই জেদ সবচেয়ে প্রবল ভাবে দেখা গিয়েছিল হেলথকেয়ার বিল প্রসঙ্গে ওবামার সবচেয়ে বিতর্কিত পদক্ষেপ। একশো বছরেরও বেশি ধরে এমন একটি রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য-নীতির কথা হয়ে চলেছে, যে নীতিতে অঙ্গীভূত করা হবে দেশের সমস্ত জনসাধারণকে, যে নীতি সর্বার্থেই ওয়েলফেয়ার-পন্থী, জাতীয় আয়ের পুনর্বণ্টনের পথ, কিন্তু একশো বছরেও কোনও প্রেসিডেন্ট বুক ঠুকে এই বিলে শেষ সিলমোহরটি মারার সাহস জোগাড় করে উঠতে পারেননি। এত মানুষকে বিমার অধীনে নিয়ে আসার যে বিপুল রাষ্ট্রীয় ব্যয়, মার্কিন সমাজের একটি বড় অংশে তার যে ভয়াবহ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হবে, সেটা আঁচ করেই কেউ এ পথে পা বাড়াননি। ওবামা কিন্তু পিছিয়ে গেলেন না। এবং ‘অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার’ নামক বিলটি পাশ করানোর জন্য যা যা সম্ভব সবই করলেন। তিক্ততম বিরোধিতার মুখোমুখি হলেন তিনি, একটা সময়ে মনে হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট পদটিও তাঁকে ত্যাগ করতে হতে পারে এ জন্য। শেষ অবধি অবশ্য সাফল্য পেলেন, কোনও ক্রমে, টেনেটুনে। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ ইতিহাসবিদ রবার্ট ডালেক (যিনি একাধিক মার্কিন প্রেসিডেন্টের ইতিহাস লিখেছেন) মন্তব্য করলেন: ওবামার এই দুঃসাহসী পদক্ষেপের সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় রুজভেল্ট-এর ‘সোশ্যাল সিকিউরিটি’ বিপ্লব কিংবা লিন্ডন জনসনের ‘মেডিকেয়ার’ সংস্কার।
বিদেশনীতির ক্ষেত্রে? চার বছরের বিদেশনীতি একত্র করে দেখলে মনে হয়: ‘পোস্ট-আমেরিকান’ বিশ্বব্যবস্থার দিকে এগোতে চেয়েছেন তিনি। এই ব্যবস্থায় আমেরিকা দৃশ্যমান থাকবে, কিন্তু তার ভূমিকা হবে আগের চেয়ে কম সক্রিয়। ওবামা-বিরোধীরা লাফিয়ে উঠে বলবেন, ওয়াশিংটন এই ভ্রান্ত পথে চলছে বলেই-না আজ ইরান তার পরমাণু-প্রকল্পের পথে প্রায় সফল হতে চলেছে, লিবিয়ায় প্রকাশ্য দিবালোকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত-নিধন হয়েছে। ওবামা-পন্থীরা পাল্টা লাফ দেবেন: ওবামার হাতে পড়ে ইজরায়েলের বেয়াদপি ইতিমধ্যেই খানিক কমেছে, পাকিস্তানকে সাফ জানিয়ে দেওয়া গিয়েছে তাদের দুমুখোপনার কথা, ইরাক যুদ্ধ শেষ হয়েছে, আফগানিস্তানে সেনা-সমাহার কমছে, আল কায়দা অস্তমিত। এই দাবি-প্রতিদাবির লড়াইয়ের মধ্যে আপাতত না গেলেও হবে। তবে বুশ-জমানার ‘ওরা-আমরা’ হুহুঙ্কারের পর যে এত তাড়াতাড়ি ‘পোস্ট-আমেরিকান সেঞ্চুরি’র আলোচনায় আসা গেল, তার জন্য ওবামার ব্যক্তিগত কৃতিত্ব বেশ অনেকটাই।
প্রচুর আশাভঙ্গ। কিন্তু পরিবর্তনও কম নয়। মুশকিল হল, বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত বিষম বলে সেই পরিবর্তনকে যথেষ্ট না-ই মনে হতে পারে। অন্য একটা মুশকিলও পাকিয়ে রেখেছেন তিনি নিজেই, গোড়াতেই। প্রথম থেকেই ‘চেঞ্জ’-এর স্লোগানে তাঁর ভর। সেখানেই ফাঁদ। এত বেশি বললে কি কোনও পরিবর্তনই ‘যথেষ্ট’ মনে হয়, ‘বেশি’ মনে হয়? এই সব নানা কারণেই দ্বিতীয় বার জয়ী হয়ে আসা তাঁর পক্ষে অসম্ভব না হলেও বেশ দুরূহ। কিন্তু ভোটের হার-জিতের বাইরেও একটা অন্য হিসেব আছে, থাকা উচিত। সেই হিসেব কিন্তু বলছে, আমেরিকার প্রথম কালো প্রেসিডেন্ট যথেষ্ট সফল। অপরাজিত। |
|
|
|
|
|