তিনি সাংসদ হয়ে যা-যা কাজ করেছেন, তাতে জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরী রেল দফতরের প্রতিমন্ত্রী হওয়ায় আশায় বুক বেঁধেছে নদিয়া-মুর্শিদাবাদ দুই জেলার মানুষ।
৩০ জুলাই থেকে ২৮ অক্টোবর৯০ দিনের ব্যবধানে এভাবে প্রেক্ষাপট বদলে যাবে তা বোধহয় খোদ অধীর চৌধুরীও ভাবতে পারেননি! অধীর চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন জেলা কংগ্রেস দীর্ঘ দিন ধরে বহরমপুর পঞ্চাননতলা ও চুঁয়াপুর রেলগেটের উপরে উড়ালপুল নির্মাণের দাবিতে সরব হয়েছে। কিন্তু উড়ালপুল নির্মিত হয়নি। শেষ পর্যন্ত গত ৩০ জুলাই ওই উড়ালপুল নির্মাণের দাবিতে অধীরবাবু শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে সভা করেন। পরে শিয়ালদহ ডিভিশনের ডিআরএম-এর কাছে স্মারকলিপিও জমা দেন তিনি। তৃণমূল কংগ্রেসের মুকুল রায় তখন রেলমন্ত্রী। ওই ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই রেল দফতরের দায়িত্ব অধীরবাবুর হাতে। ফলে বহরমপুরে দুটি উড়ালপুল নির্মাণের দাবিপূরণ এখন সময়ের অপেক্ষা বলে মনে করছেন বহরমপুর তথা জেলার মানুষ। জেলা চেম্বার অফ কমার্সের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রদ্যোৎ দে বলেন, “জেলার মানুষের দীর্ঘ দিনের দাবি উড়ালপুল নির্মাণের। অধীরবাবু রেল দফতরের মন্ত্রী হওয়ায় উড়ালপুল নির্মাণ এখন সময়ের অপেক্ষা। কেননা, বহরমপুর শহরের যানজট এড়াতে এবং যানবাহনের গতি বাড়াতে অবিলম্বে শহরে দুটি উড়ালপুল নির্মাণ করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে দ্রুত ডবল লাইনের কাজ সম্পন্ন হলে সাধারণ যাত্রী থেকে ব্যবসায়ীরাও দারুণ ভাবে উপকৃত হবেন।” |
জেলার ব্যবসায়ীদের দাবি, লালগোলা-শিয়ালদহ শাখায় একটি সুপার ফাস্ট এবং একটি সম্পূর্ণ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ারকার ট্রেন দিতে হবে। প্রদ্যোৎবাবু বলেন, “প্রতি দিন ৩০-৩৫টি অ্যাম্বুলেন্স বহরমপুর থেকে কলকাতার সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে রোগী বয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের বেহাল দশার কারণে ওই রাস্তা অতিক্রম করা প্রাণান্তকর হয়ে ওঠে। এখন ট্রেনের একটি কামরা রোগী বহনের জন্য সংরক্ষণ খুব জরুরি। তবে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে উত্তর পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য নশিপুর রেল সেতু নির্মাণ অবিলম্বে করতে হবে।”
এর আগে ২০১০ সালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেল বাজেটে কৃষ্ণনগর-চাপড়া-করিমপুর হয়ে বহরমপুর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের ঘোষণা করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। ওই প্রসঙ্গ তুলে করিমপুর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বিধান দত্ত বলেন, “রেলপথ গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু রেলপথ গড়ে তোলার কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। পাশাপাশি বাস করার সুবাদে অধীরবাবু আমাদের সমস্যার কথা ভালই জানেন। এখন তিনি প্রতিশ্রুতি দেবেন নাকি সত্যিই কাজ করে দেখাবেন তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।” |
করিমপুর উদ্যান ও কৃষি কল্যাণ সমিতির সম্পাদক বিশ্বনাথ বিশ্বাস অবশ্য বলেন, “করিমপুর এলাকায় প্রচুর পরিমাণে পান চাষ হয়ে থাকে। ওই পান জেলার বিভিন্ন প্রান্তের পাশাপাশি অন্য রাজ্যেও রফতানি হয়। রেল সংযোগ গড়ে না ওঠার ফলে পান রফতানির ক্ষেত্রে চাষিদের সমস্যায় পড়তে হয়। করিমপুরের মানুষের ওই সমস্যা থেকে রেহাই দিতে অধীরবাবু সচেষ্ট হবেন বলেই এলাকাবাসী আশায় রয়েছেন।”
কান্দি রেলওয়ে সংযুক্তিকরণ কমিটি’র সম্পাদক প্রভাত কর বলেন, “২০০৯ সালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চৌরিগাছা থেকে কান্দি হয়ে সাঁইথিয়া পর্যন্ত ৬২ কিমি রেলপথ নির্মাণের ঘোষণা করেন। ২০১০ সালে রেল বোর্ড তা অনুমোদন করে। সেই মত ২০১১ সালের মধ্যে ওই রেলপথের সমীক্ষাও হয়। কিন্তু কোনও অজানা কারণে এখন পর্যন্ত ওই রেলপথ নির্মাণ হয়নি। এলাকার সাংসদ অধীর চৌধুরী রেল দফতরের প্রতিমন্ত্রী হওয়ায় আমরা এখন ওই রেলপথ গড়ে তোলার ব্যাপারে ভীষণ ভাবে আশাবাদী।”
কান্দি ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক তারকনাথ প্রামাণিক বলেন, “অধীরবাবু সাংসদ অবস্থায় বিভিন্ন রাস্তাঘাট নির্মাণ করে এলাকার অর্থনীতির ভোল বদলে দিয়েছেন। কান্দি থেকেই সরাসরি কলকাতা ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রেলের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।” বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যক্ষ সোমেশ রায় বলেন, “রেলের উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সমস্ত জটিলতা কাটিয়ে নশিপুর রেলসেতু চালু, লালগোলা-শিয়ালদহ ডবল লাইনের কাজ ত্বরান্বিত করা, বহরমপুরের দুটি উড়ালপুল নির্মাণের ব্যাপারে অধীর চৌধুরী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেবেন বলেই আমি বিশ্বাস করি। তবে লালগোলা থেকে কল্যাণী পর্যন্ত নতুন ট্রেনের ব্যবস্থা করলে ভাল হয়। কেননা, মুর্শিদাবাদের সমস্ত কলেজ তো এখন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। নতুন ট্রেন চালু হলে ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতে সুবিধা হবে।” |
একনজরে অধীর |
|
রাজীব গান্ধীর সঙ্গে। |
• বাবা: প্রয়াত নিরঞ্জন চৌধুরী (সমাজসেবী)।
• মা: প্রয়াত সরযুবালা চৌধুরী।
• জন্ম: ১৯৫৬ সালের ২রা এপ্রিল। ৪ ভাই, ২ বোন।
• স্ত্রী: অর্পিতা চৌধুরী।
• ১৯৯১ সাল: নবগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী। সেই সময়ে সিপিএম প্রার্থীর কাছে ১১১০ ভোটে তিনি হেরে যান। ভোটের দিন বাগিরাপাড়া ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের ভিতরে অধীর চৌধুরী ও মান্নান হোসেনকে নিরাপত্তারক্ষী-সহ ভোটকর্মীদের আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়।
|
১৯৯৬ সালে। |
• ১৯৯৬ সাল: কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে অধীর চৌধুরী ফের নবগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটে দাঁড়ান। কিন্তু সিপিএম নেতা মানব সাহা খুনের ঘটনায় তাঁর নাম জড়িয়ে যাওয়ায় তিনি ভোটপ্রচারেও নবগ্রামে আসতে পারেননি। ভোটের সময়ে রাজ্যের বাইরে আত্মগোপন করে ছিলেন। তা সত্ত্বেও সিপিএমের মোজাফফর হোসেনকে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার ভোটে পরাজিত করেন তিনি।
• ১৯৯৯ সাল: বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী। আরএসপি প্রার্থী প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়কে ৯৬ হাজার ভোটে পরাজিত করেন অধীর চৌধুরী।
• ২০০১ সাল: কান্দির বিধায়ক অতীশ সিংহের জায়গায় মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেস সভাপতি হন অধীর চৌধুরী।
|
২০০৪ সালে জয়ের পরে। |
• ২০০৩ সাল: জেলা কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পরেই অধীর চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রথম বার মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদ দখল করে কংগ্রেস। ৬৩টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস পায় ৩৩টি আসন এবং বামফ্রন্ট ৩০টি আসনে জয়ী হয়। সভাধিপতি হন সিদ্দিকা বেগম।
• ২০০৪ সাল: বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে ৯৯,৪০৫ ভোটে জয়ী হন। সেই সঙ্গে তাঁর অনুরোধ মেনে জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রণববাবু ও মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী মান্নান হোসেনকে জয়ী করার ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা রয়েছে।
• ২০০৫ সাল: বহরমপুর সদর হাসপাতালের কাছে জোড়া খুনের ঘটনায় অধীর চৌধুরীর নাম জড়িয়ে যায়। পরে তাঁকে দিল্লির
|
২০০৯ সালে
জয়ের পরে। |
সরকারি বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে বহরমপুরে নিয়ে আসে পুলিশ। প্রায় দেড় মাস বিচারাধীন বন্দি হিসেবে জেলে ছিলেন। কলকাতা হাইকোর্টে নির্দেশে জামিনে মুক্তি পান। পরে ওই মামলা থেকে বেকসুর খালাস পান তিনি।
• ২০০৬ সাল: এক মাত্র সন্তান শ্রেয়াশ্রী চৌধুরী ওরফে নিটি’র অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় কলকাতায়।
• ২০০৯ সাল: বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে রেকর্ড সংখ্যক ১ লক্ষ ৮৬ হাজার ভোটে জয়ী হন অধীর চৌধুরী।
• ২০১১ সাল: তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে ‘জোট’ না করেই অধীর চৌধুরীর নেতৃত্বে বিধানসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ জেলার ২২টি আসনের মধ্যে ১৪টি আসনে জয়ী হন কংগ্রেস প্রার্থীরা।
• ২০১২ সাল: রেল দফতরের কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী। |
|