নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
এত দিন মাটির প্রতিমাই পুজো করছিলেন ওঁরা। এ বার মাটির বদলে পিতলের উপরে ছাপ তোলা (এমবস করা) প্রতিমা মণ্ডপে এনেছেন শিল্পী। কিন্তু খরচের তেমন হেরফের ঘটেনি। প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়নি গঙ্গায়। চলে গিয়েছে সরকারি একটি সংগ্রহশালায়।
পুজোর উদ্যোক্তা রানা দাস জানাচ্ছেন, প্রতিমার এই ধারাই এ বার থেকে বজায় রাখতে চান তাঁরা। রানার কথায়, “মাটির ঠাকুর গঙ্গায় ফেললে দূষণ অবধারিত। এই ধরনের প্রতিমা গড়ে আমরা অন্তত দূষণ মোকাবিলার লড়াইয়ে সামিল হতে পারলাম!”
মাটির প্রতিমা গড়তে যে রং ব্যবহার করা হয়, তার সীসা (লেড) থেকেই মূলত দূষণ ছড়ায় বলে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ পরিবেশবিদদের। তার সঙ্গে প্রতিমার কাঠামোর কাঠ, খড় ইত্যাদি তো রয়েইছে। দূষণ কমাতে গত কয়েক বছর ধরে শহরে কয়েকটি প্রতিমায় সীসাবিহীন রং ব্যবহার করা হলেও তা সংখ্যার অনুপাতে একেবারেই নগণ্য। এই অবস্থায় দূষণ-বিরোধী লড়াইয়ে মৃন্ময়ী মূর্তির উপকরণ বদলের ভাবনা সমর্থন পাচ্ছে অনেক মহলেই।
রানার মতো কলকাতার অনেক পুজোর উদ্যোক্তাই এ বার এই পথে দূষণ-বিরোধী অভিযানে নেমেছেন। শহরের তিনটি মণ্ডপে প্রতিমা তৈরি হয়েছে ফাইবার গ্লাস দিয়ে। একটি মণ্ডপে প্রতিমা তৈরি হয়েছে সেরামিক টালি দিয়ে। ওই প্রতিমাগুলিরও ঠাঁই হয়েছে এক সরকারি সংগ্রহশালায়। |
এ বার যে তিনটি মণ্ডপে ফাইবার গ্লাসের প্রতিমা তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে একটির নির্মাতা ভবতোষ সুতার। ভবতোষ এর আগে গালা, মেহগনি কাঠ, পোড়ামাটি, পিতল-তামা-লোহার মিশ্রণে প্রতিমা গড়েছেন। ওই সব প্রতিমার একটিও কিন্তু গঙ্গায় পড়েনি। সংরক্ষিত রয়েছে বিভিন্ন সংগ্রহশালায়। দূষণ-বিরোধী এই অভিযান কতটা সফল হবে? ভবতোষ বলেন, “কখনও-সখনও অন্য মাধ্যমে প্রতিমা গড়েছি। তবে সব সময়ে তা সম্ভব নয়। আর মাটি ছাড়া অন্য যা কিছু দিয়েই প্রতিমা গড়া যাক না কেন, তাতে খরচ অনেক বেশি। সব পুজো কমিটির পক্ষে তা বহন করা কঠিন। গঙ্গা-দূষণ কমাতে নিশ্চিত ভাবে ফাইবার গ্লাস, কাঠ বা পোড়ামাটির প্রতিমা গড়া যায়। কিন্তু সর্বজনীন পুজোর ক্ষেত্রে এখনও মাটির প্রতিমার বিকল্প নেই।” কাঠের প্রতিমায় অবশ্য ঘোর আপত্তি রয়েছে পরিবেশবিদদের। তাতে বৃক্ষনিধন বাড়বে বলেই তাঁদের আশঙ্কা। তবে পুজো উদ্যোক্তাদের একাংশের বক্তব্য, প্রতিমা না গড়লেও বাজারে কাঠ তো আসছে। প্রতিমার জন্য তাই আলাদা করে বৃক্ষনিধনের প্রশ্ন ওঠে না।
বিদেশে একই প্রতিমায় একাধিক বার পুজো হয়। সারা বছর প্রতিমা কোনও ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় থাকে। পরের বছর তা ঘষেমেজে ফের পুজো হয়। এখানে অবশ্য মাটির বিকল্প জিনিস দিয়ে প্রতিমা গড়ায় অনেক পুজোর উদ্যোক্তা রাজি থাকলেও একই প্রতিমায় দু’বার পুজো করায় রাজি নন কেউই। তাঁদের সংস্কারে বাধছে। যদিও শাস্ত্র মতে, এক প্রতিমায় একাধিক বার পুজোয় কোনও বাধা নেই। প্রতিমা বিসর্জন না দিয়ে তা সংরক্ষণের মধ্যেও কোনও ধর্মীয় অনিয়ম দেখছেন না পণ্ডিতেরা। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার সঙ্গে যুক্ত হিমাংশু স্মৃতিতীর্থ বলেন, “প্রতিমা যে ভাসান দিতে হবে, তার কোনও শাস্ত্রীয় নিয়ম নেই। মূল বিসর্জন হয়ে যায় দর্পণে। প্রতিমা সারা বছর রেখে দেওয়া যায়। পরের বছর ঘষেমেজে সেই প্রতিমাতেই পুজো করা যায়। এতে শাস্ত্রীয় বিধির কোনও লঙ্ঘন হয় না।”
প্রতিমা যে মাটিরই হতে হবে, তা-ও মানেন না হিমাংশুবাবু। তাঁর শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা, “প্রতিমা মাটি, পাথর, কাঠ, সোনা, রুপো বা অন্য ধাতুতে তৈরি হতেই পারে। বিভিন্ন রাজবাড়ি বা মন্দিরে সোনা, রুপো বা পিতলের তৈরি প্রতিমার পুজো হয়ে চলেছে বছরের পর বছর। প্রতি বার পুজোর সময়ে ওই প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। মূল পুজো তো হয় ঘটে।”
রানা দাসদের মতো কয়েক জন উদ্যোক্তা মাটি ছাড়া বিকল্প প্রতিমায় পুজো করতে উদ্যোগী হলেও রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের মতো উদ্যোক্তারা মনে করেন, মাটির প্রতিমা ছাড়া পুজোই হয় না। তবে গঙ্গার দূষণ কমাতে বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। কী সেই বিকল্প পথ? অরূপ বলছেন, “গঙ্গায় নির্দিষ্ট একটা জায়গা সিমেন্ট দিয়ে ঘিরে সেই এলাকাটা কেবল প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা যেতে পারে। তাতে ওই জায়গার দূষণ অন্য কোথাও ছড়াবে না। পুরসভাগুলি ওই জায়গার রক্ষণাবেক্ষণ করবে।”
গঙ্গায় এমন ব্যারিকেড দেওয়ার বিরোধী অধিকাংশ পরিবেশবিদই। তাঁরা বলছেন, গঙ্গায় স্বাভাবিক ভাবে যে জোয়ার ভাটা হয়, জলে ব্যারিকেড দিলে তা বাধা পাবে। নষ্ট হবে গঙ্গার প্রাকৃতিক ভারসাম্যও। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলেন, “বেঙ্গালুরুর আলসুর লেকের একটি অংশ সিমেন্ট দিয়ে ঘেরা রয়েছে। সব প্রতিমা ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলেই বিসর্জন দিতে হয়। পুরসভা সেখান থেকে বর্জ্য তুলে নিয়ে যায়। ওই জল ঘেরাটোপের বাইরে লেকের জলের সঙ্গে মেশে না।” ভবতোষও সুভাষবাবুর এই মতের সমর্থক। তিনি মনে করেন, “কয়েকটি ঝিলে নির্দিষ্ট এলাকাকে বিসর্জনের জন্য সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করে দিক রাজ্য সরকার। তা হলে গঙ্গার উপরে আর চাপ পড়বে না।” মজার বিষয় হচ্ছে, গঙ্গায় দেদার বিসর্জন হলেও শহরের বহু বিল বা পুকুরে কিন্তু বিসর্জন নিষিদ্ধ।
গঙ্গায় বিসর্জন বন্ধ করতে বহু দিন ধরেই সরব পরিবেশবিদ কল্যাণ রুদ্র। ২০০৫ সালে কলকাতা হাইকোর্ট গঙ্গায় বিসর্জনজনিত দূষণ রোধে যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে দিয়েছিল, কল্যাণবাবু তার অন্যতম সদস্য। তিনি বলেন, “শহরের মাঝে এমন একটি জায়গা নির্দিষ্ট করা হোক, যেখানে সব পুজো কমিটি তাদের প্রতিমা সার দিয়ে রাখবে। আর দমকলের হোস পাইপ দিয়ে সেই প্রতিমার মাটি গলিয়ে দেওয়া হবে। ওই মাটি এবং অন্য বর্জ্য ছেঁকে নিয়ে জল ফেলে দেওয়া হবে নিকাশি পাইপে।”
বিসর্জনের পরে দূষণ কমাতে প্রতিমা এবং পুজোর সব উপকরণ তুলে নেওয়া হয় বলে সরকার, পুরসভা বা কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের তরফে দাবি করা হলেও তা মানতে নারাজ অনেকেই। কল্যাণবাবু বলেন, “গঙ্গা থেকে সব কিছু তুলে নেওয়ার দাবি করা হলেও জোয়ার-ভাটার টানে অনেক সামগ্রীই ভেসে চলে যায় অনেক দূরে। সেগুলি যখন পচতে শুরু করে, তখন জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন টেনে নেয়। জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনে টান পড়লে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীদের জীবনধারণের ক্ষমতা কমে যায়।” ওই পরিবেশবিদ চান, রাজ্যে গঙ্গা তীরবর্তী ৪২টি পুরসভা গঙ্গায় বিসর্জন বন্ধ করতে এই ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা নিক।
|
বিসর্জনের গঙ্গা |
কীসে দূষণ |
• জলে ও পলিতে মেশে রঙের রাসায়নিক।
• কাঠামো, ফুল-বেলপাতায় পচন ধরে।
• জলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়
• জলে কলিফর্ম ব্যাক্টেরিয়া বেড়ে যায়। |
|
|
ক্ষতি কী |
• জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের ক্ষতি।
•
জল ব্যবহারকারীরাও বিপদে পড়েন। |
বিকল্প |
• ফাইবার গ্লাস বা ধাতু দিয়ে প্রতিমা নির্মাণ।
• জলাশয়ে নির্দিষ্ট অংশ ঘিরে বিসর্জন।
• মাটির প্রতিমা জলের তোড়ে গলানো।
• একই প্রতিমায় কয়েক বছর পুজো করা। |
|