দাউদাউ করে জ্বলছে পাটকাঠির গাদা, শুকনো গাছের ডাল। আগুন লেগেছে ঘরের চালেও। দমকা হাওয়ায় তা ছড়িয়ে পড়ছে একের পর এক বাড়িতে। এলাকা থেকে দূরে সরে গিয়েছেন অনেকেই। কয়েক জন রয়েছেন জিনিসপত্র বাঁচানোর চেষ্টায়। তখনও যে একটি বাড়িতে দোলনায় দুলছে মাস ছয়েকের এক শিশু, ভুলে গিয়েছিলেন সকলে। সে খবর কানে আসতে দেরি করেননি বছর কুড়ির সফিকুল মোল্লা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জ্বলন্ত সেই ঘরে ঢুকে শিশুটিকে বের করে এনে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তিনি। কালনার কালীনগর গ্রামে অগ্নিকাণ্ডের সপ্তাহখানেক পরে সব হারানোর আক্ষেপের মধ্যেও তাই সবার মুখে ঘুরছে সফিকুলের নাম।
কালনা ১ ব্লকের ধাত্রীগ্রাম পঞ্চায়েতের এই কালীনগর কবাডি গ্রাম নামে পরিচিত। ২১ অক্টোবর গ্রামের মল্লিকপাড়ায় আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায় প্রায় ৫৫টি বাড়ি। পাড়ার মোরাম রাস্তার পাশে বাড়ি সুকুর মল্লিকের। কখনও খেতমজুরি, কখনও রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে সংসার চালান সুকুর। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সুকুরের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটি বাড়িতেই প্রথম আগুন লাগে। পড়শির বাড়িতে আগুন নেভানোর কাজে বেরিয়ে পড়েন তিনি। আশপাশের লোকজনের সঙ্গে সেই কাজে হাত লাগাতে যান সুকুরের স্ত্রী বেবিনাজ বিবি, মা আদরি বেউয়া ও ভাই শোভর আলি মল্লিকও। তার আগে তাঁরা সুকুরের ছ’মাসের ছেলে রাজকে এক পড়শির কোলে দিয়ে যান। গ্রামবাসীর দাবি, সেই পড়শির কাছে খেলছিল রাজ। আগুন কতটা ভয়াবহ, তা দেখতে বেরোনোর জন্য ওই পড়শি নিজের বাড়ির দোলনায় রাজকে শুইয়ে রেখে বাইরে বেরোন। |
ইতিমধ্যে ভাগীরথীর দিক থেকে বয়ে আসা হাওয়ায় আগুন ছড়াতে শুরু করেছে। দৌড়দৌড়ির মধ্যে সকলে ভুলে যান রাজের কথা। হঠাৎ শিশুর কান্না কানে আসে এক কিশোরের। দৌড়ে গিয়ে সফিকুলকে তা জানায়। কালনা কলেজের বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র সফিকুল চলতি বছরেই কলকাতার একটি ক্লাবের হয়ে যোগ দিয়ে এসেছেন কবাডির স্টেট সাব-জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে। শিশুর বিপদের কথা শুনে এক মুহূর্ত দেরি করেননি তিনি। তাপ থেকে বাঁচতে প্রথমে গায়ে কাদা মেখে নেন। তার পরে পুড়তে থাকা বাড়ির মধ্যে একটি ছোট গলি দিয়ে পৌঁছে যান রাজের কাছে। সফিকুলের কথায়, “গোটা ঘর ভরে গিয়েছিল ধোঁয়ায়। দরজা, জানালা দিয়ে আগুনের শিখা ধেয়ে আসছিল। কোনও রকমে শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসি।” তাপে দেহের কয়েক জায়গায় ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল বলেও জানান তিনি।
সফিকুলের দাদা, সিআইএসএফ জওয়ান জাহির আব্বাস বলেন, “ঘটনার সময়ে ভাইয়ের কাছাকাছি ছিলাম। খবর পেয়েই ও দৌড়ে গেল। ওর দাদা হিসেবে আমার গর্ব হচ্ছে।” সফিকুলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ রাজের ঠাকুমা আদরি বেউয়া। তাঁর কথায়, “আগুনের তাপে নাতির চোখের পাতা প্রায় পুড়ে গিয়েছে। সফিকুল সময় মতো না পৌঁছলে বড় বিপদ ঘটে যেত। প্রার্থনা করি, ওর ভাল হোক।” রাজের মা বেবিনাজ বিবি অবশ্য সে দিনের কথা মনে পড়লে শিউরে উঠছেন। তিনি বলেন, “পড়শির ঘরে আগুন লেগেছে শুনে বাড়ির সবাই বেরিয়ে পড়েছিলাম। পরে শুনি, আমার ছেলেও বড় বিপদে পড়েছিল। যিনি তাকে রক্ষা করেছেন, আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।”
কালীনগরের বাসিন্দা, ওয়েস্ট বেঙ্গল কবাডি অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক হাবিব শেখ বলেন, “মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে যে ভাবে সফিকুল এক শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছে, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।” তাঁর দাবি, বিপদের দিনে গোটা গ্রাম এক হয়ে লড়াই করেছে। কিন্তু তারই মধ্যে বিশেষ সাহসিকতার জন্য সফিকুল-সহ পাঁচ জনের পুরস্কার পাওয়া উচিত।
কালনা ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শান্তি চাল বলেন, “শিশুকে বিপদের হাত থেকে এক যুবকের বাঁচানোর খবর শুনেছি। পঞ্চায়েত সমিতির তরফে কোনও অনুষ্ঠানে তাঁকে পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। অন্যদের সাহসিকতার কথা জানতে পারলে সে ব্যাপারেও খোঁজ নেওয়া হবে।” সফিকুলের অবশ্য পুরস্কার নিয়ে বিশেষ হেলদোল নেই। বলছেন, “এমন পরিস্থিতি আবার হলে, একই রকম কাজ করব।” |