এক নোবেলজয়ীর তোপের মুখে আর এক নোবেলজয়ী।
এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে। এক ব্রিটিশ দৈনিকের পাতায় সেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকাকেই তীব্র সমালোচনা করে একটি লেখা লিখেছেন তুরস্কের নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ওরহান পামুক। ওরহান কোনও রকম রাখঢাক না করেই বলেছেন, “মুসলিম প্রধান দেশ হওয়াতেই তুরস্ককে ইইউ-এর সদস্য করার ব্যাপারে এত অনীহা ইউরোপের দেশগুলির।”
ইউরোপীয় ইউনিয়নের আওতায় এখন রয়েছে ২৭টি সদস্য রাষ্ট্র। তার মধ্যে তুরস্কের ঠাঁই নেই। গত সাত বছর ধরে নাগাড়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে সওয়াল করে আসছে তুরস্ক। এখনও মেলেনি সদস্যপদ। সময়ের সঙ্গে কিছুটা যেন ঝিমিয়ে পড়েছে তুরস্কের অন্তর্ভুক্তির চেষ্টাও। পামুকের মতে, আধুনিকতার দিশারী ইউরোপ আজ নিজেই রক্ষণশীলতার খোলসে আটকা পড়েছে। উত্তর আমেরিকা এবং এশিয়া থেকে বহু মুসলিম এসে আস্তানা গেড়েছেন ইউরোপে। আর এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে খ্রিস্টানপ্রধান দেশগুলি। সেই কারণেই তুরস্কের মতো মুসলিমপ্রধান দেশ আর স্বাগত নয় ইইউ-এ।
পামুক সখেদে বলেছেন, ইউরোপের যে দু’টি দেশ বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর, তারা হল জার্মানি এবং ফ্রান্স। অথচ ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ পর্যন্ত এক দশক ধরে এই ফ্রান্সেই জনপ্রিয় হয়েছিল ‘লির্বাটি, ফ্র্যাটারনিটি, ইক্যুয়ালিটির’ (স্বাধীনতা, মৈত্রী ও সাম্য) বাণী। ধীরে ধীরে যা ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত ইউরোপে। কিন্তু গত বেশ ক’বছর ধরেই সেই আপাত ‘উদার’ ইউরোপের ভাবনাচিন্তায় ক্রমাগত দেওয়াল উঠছে। আর সেই সঙ্গে পাঁচিল উঠছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চৌহদ্দিতে। সেখানে নতুন দেশ আর কাম্য নয়। বিশেষত এমন এক দেশ যে দেশের ৯৯ শতাংশ জনতাই ইসলাম ধর্মাবলম্বী।
অথচ ভৌগোলিক দিক থেকে এশিয়া-ঘেঁষা তুরস্কের বেশির ভাগ মানুষ চলনে বলনে নিজেদের ইউরোপীয় বলেই ভাবতে পছন্দ করেন। পামুক স্পষ্ট জানিয়েছেন, তাঁর মতো আরও অনেক উচ্চ মধ্যবিত্ত তুর্কীই বিশ এবং তিরিশের দশকে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের পাশ্চাত্য ঘেঁষা সংস্কার মেনে নিয়েছিলেন সানন্দে। যার একটাই কারণ। ধর্মনিরপেক্ষতা। তখন থেকেই ইউরোপের চোখে তুরস্ক আধুনিকতার বাহক বলেই পরিচিত হয়ে ওঠে। পরবর্তী কালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার পিছনে তুরস্কের আপ্রাণ চেষ্টার পিছনেও সেই আধুনিকতার ভাবনাই কাজ করেছে।
বাস্তবিক। রেনেসাঁস, ফরাসি বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব সমস্ত কিছুই তো ঘটেছিল ইউরোপে। এবং এই সমস্ত বিপ্লবের পিছনে ইন্ধন জুগিয়েছিল যে শক্তি, তা ছিল সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ। উদার। সেই উদার ইউরোপকেই অনুকরণ করেছিল তুরস্ক। অথচ সেই ইউরোপের কাছ থেকেই জুটছে প্রত্যাখ্যান। এটা কিছুতেই মেলাতে পারছেন না নোবেলজয়ী সাহিত্যিক।
বেশ ক’বছর আগে ওরহান নিজেই তুরস্কের ইইউ সদস্য হওয়ার সপক্ষে সওয়াল করেছিলেন। বুঝিয়েছিলেন, খ্রিস্টানপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপের মূল পরিচয় সেটা নয়। তার মূল পরিচয় আধুনিকতায়। আজ সেই ওরহানই বলেছেন, “এখন ইউরো-সঙ্কটে ভুগছে তামাম ইউরোপ...এ হেন অবস্থায় তুরস্কের সদস্যপদ পাওয়ার ইচ্ছাটাও যেন উবে গিয়েছে।” কারণ?
দেওয়াল উঠছে। উঠেই চলেছে। |