পুজো মানে নতুন পোশাক, খাওয়াদাওয়া, রাত জেগে মণ্ডপে ঘুরে ঠাকুর দেখা, আড্ডা মারা। পুজোর ছুটিতে বাঙালি যা চুটিয়ে উপভোগ করে তা হল নির্ভেজাল আড্ডা। আড্ডাবাজ বাঙালির আড্ডার আসর বসে পাড়ার পুজো, বাড়ির পুজো, আবাসনের পুজো---সব মণ্ডপে। জলপাইগুড়ির বারোয়ারি পুজোগুলিতে এর ব্যতিক্রম নেই। শহরের বিগ বাজেটের পুজোগুলির অন্যতমতরুণ দল। সারা বছর সংসার সামলেও অঞ্জু সরকার, পপি রায়চৌধুরী, কল্পনা রাহা। মণি সরকারদের চারদিন কাটে অন্য ভাবে। সন্ধ্যা ৭টা ৮টা থেকে ওরা জড়ো হতে থাকে পুজো প্রাঙ্গণে। এর মধ্যে বাড়ির রান্নাবান্না আর সাজগোজের পালা শেষ। এর পরে শুধুই আড্ডা আর আড্ডা। ছেলেমেয়েদের কথা, পরনিন্দা-পরচর্চা, দর্শনার্থীদের সাজপোশাক এ সব মিলিয়ে পুজোর চারটে দিন ওরা মশগুল হয়ে থাকে। খুচখাচ টুকটাক চলতে থাকে ডিমের ওমলেট, আইসক্রিম, কোল্ড ড্রিঙ্কস এবং অবশ্যই চা। ‘সাপ্লায়ার’ পাড়ার দাদা, ভাই, দেওররা। বধূ অঞ্জু জানালেন, সারা বছর আমরা ওই আড্ডার জন্য আপেক্ষা করে থাকি। পুজোর চারটে দিন মন্ডপে কেটে যায়। আড্ডা ছেড়ে ঠাকুর দেখার কোনও ব্যাপার নেই। ওই আড্ডায় পঁচাশি পোরোনো রাজেশ্বর চৌধুরী, বছর ছিয়াত্তরের বরেন রায়, সত্তরোর্ধ্ব রণজিৎ ভৌমিক অথবা পঁচাত্তরে পা দেওয়া সন্তোষ চক্রবর্তীরাও আড্ডার আসরে ফিরে পান ছেলেবেলার দিন। সৌরভ, ঐন্দ্রী, সজল, মাম্পি, বিপ্লব, শ্রেয়া হাজির থাকবে রাজবাড়ির অষ্টমীর দুপুরে। চাকরি সূত্রে সবাই কলকাতার বাসিন্দা। আজ বেঙ্গালুরু, কাল হায়দরাবাদ, পরশু চেন্নাই ছুটে বেড়াতে হলেও পুজোর টানে ঘরে ফেরা। আর ওদের পুজো মানে রাজবাড়িতে অষ্টমীর আড্ডা। সেই আড্ডায় ঝলকে ওঠে স্কুল ও কলেজ জীবনের স্মৃতি, অফিসের টানাপোড়েন, ভবিষ্যত ভ্রমণ ভাবনা এমন কত কী! আড্ডার মাঝে দুপুরে প্রসাদ ভোগে পেট ভরানো। সেই অর্থে ছুটি বলে কিছু নেই। সারা বছরে এত পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়া একবারই। পুজোকে ঘিরে শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় আড্ডাপীঠ তৈরি হয় কদমতলা পুজো কমিটির মন্ডপ ঘিরে। কচিকাঁচা, যুবকযুবতী থেকে প্রাচীন মানুষেরাও এখানে আড্ডা জমান। রাস্তার দু’পাশে চুড়ি-মালা, বেলুনওয়ালা, গোলাপী বুড়ির চুল ওয়ালা ক্যান্ডি, ফার্স্ট ফুডের সার সার দোকান। ঠিক যেন মেলা। এরই মাঝে রাস্তার ধারে, পুজো প্রাঙ্গণের অনেকটা জুড়ে, দোকানের সামনে জমাটি আড্ডা। সকালবেলা বাজারের পাট চুকিয়েই প্রশান্ত মুখোপাধ্যায়, অশোক গঙ্গোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মৌলিক, সকাল ৯টা থেকে আড্ডার টানে হাজির হন। পাতকাটা কলোনির অগ্রণী সঙ্ঘ ক্লাব পাঠাগারের আড্ডার চরিত্রটা অন্যরকম। এই এলাকার প্রতিটি বাড়িতেই মেসবাড়ি। বাসিন্দা জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং ও পলিটেকনিক কলেজের ছাত্ররা। সবাই অন্য জেলার বাসিন্দা। সপ্তমী ও অষ্টমী এদের আড্ডাতেই সরগরম হয়ে ওঠে পুজো চত্বর। শুভঙ্কর দেবনাথ, সুশান্ত সাহাদের নিজেদের বাড়িতে ফেরার সময় অষ্টমীর রাত্রে। তার আগে এটাই তাঁদের নিজেদের পুজো। উকিলপাড়ার দুর্গাপুজো কমিটির মণ্ডপের সামনে এক ফালি মাঠ। পুজোর দিনে বুলাই, জাপটু, ঘোতন, সোনাই, টুসিদের মতো কচিকাচাদের আনন্দ মেলা। আলো বসু, রানু চক্রবর্তী, ভারতী দে, মঞ্জু মুখোপাধ্যায়রা সপ্তমীর সন্ধ্যা থেকেই হাজির হন পুজো প্রাঙ্গণে। এবারের পুজোয় বাজার মাত করা শাড়ি, গয়না, নতুন কাটের ব্লাউজ, হাল ফ্যাশন এসব আলোচনা করতে করতেই সময় কাটে। বধূ জুঁই বসু জানান, চারদিন বেশির ভাগেরই খাওয়া-দাওয়া বাইরে। সুতরাং নিশ্চিন্তে আড্ডা জমতে বাধা নেই। |