|
|
|
|
জলে কর চাইছে রাজ্যেরই কমিটি
জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
জলের উপর কর না বসানোর গোঁ ধরে এডিবি-র ৩০ কোটি ডলার ঋণ হারাতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। অথচ ক্ষমতায় আসার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের জল-নীতি তৈরির জন্য যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়েছিলেন, তারাই এখন বলছে, জলের জন্য দাম নাও। অর্থাৎ কর বসাও।
রাজ্যের সেচসচিবের নেতৃত্বে ১৫ মাস ধরে বিচার বিবেচনার পরে এই কমিটি যে খসড়া জল-নীতি তৈরি করেছে, সেখানে বলা হয়েছে, শিল্পে ব্যবহার্য জল তো বটেই, কিনতে হবে পানীয় এবং চাষের জলও। মূলত জলের অপচয় রোধ করতেই যে কর বসানোর ভাবনা, সে কথাও সুপারিশে উল্লেখ করেছে কমিটি। গত সপ্তাহেই এই জল-নীতি রাজ্য সরকারের কাছে জমা দিয়েছে তারা।
কিন্তু মমতা যেখানে জল কর নেওয়ার বিরোধী, সেখানে এমন নীতির খসড়া তৈরি হল কী ভাবে? সরকারি সূত্রের বক্তব্য, কোনও একটি রাজ্যের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের এবং অন্যান্য রাজ্যের গৃহীত অবস্থানগুলি খতিয়ে দেখা হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় দেশের অন্য রাজ্যে যা চলছে, কোনও একটি রাজ্য তার উল্টোপথে হাঁটতে পারে না। অর্থাৎ অন্য রাজ্যগুলি যদি জল কর নেয়, তা হলে এ রাজ্যকেও সেই ব্যাকরণ মেনেই চলতে হবে। আবার আর একটি মত হল, এই কমিটি যখন রিপোর্ট তৈরির কাজ চালিয়েছে, তখন সেচ দফতর শরিক কংগ্রেসের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়ার হাতে ছিল। তাতে জল কর নিয়ে কেন্দ্রীয় নীতির প্রভাব পড়াই স্বাভাবিক।
কিন্তু মমতা কী করবেন? তাঁর এখনও ঘোষিত অবস্থান, তিনি জনগণের উপরে কোনও রকম কর বসানো বা ভাড়া বৃদ্ধির বিরোধী। এডিবি-র শর্ত নিয়ে এ যাবৎ সরকারের অনড় অবস্থানের কথা মাথায় রেখে রাজ্যের আমলাদের মধ্যে অনেকের প্রশ্ন, বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশও কি মানবেন মমতা? নাকি পত্রপাঠ খারিজ করে দেবেন? আবার এমনও কেউ কেউ বলছেন, বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশকে সামনে রেখে কৌশলে জল কর বসানোর সিদ্ধান্তের দিকেই এগোতে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ঠিক যেমন সম্প্রতি জনগণের দাবিকে সামনে রেখে দক্ষিণ শহরতলির কিছু রুটে বাস ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসন।
কোনও রকম কর না থাকায় জলের যে অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, তার উপরে লাগাম টানায় জোর দেওয়া হয়েছে খসড়া জল-নীতিতে। নীতিতে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি সামলাতে রাজ্যকে এখনই বিনা পয়সায় জল দেওয়ার নীতি ছাড়তে হবে। রাজ্যে জলের বাজার এবং জল-অর্থনীতি নিয়ে সরকারি স্তরে এখনও কোনও বিধিবদ্ধ ধারণা নেই। তাই কমিটির সুপারিশ, জল-অর্থনীতি ও তার সম্ভাব্য বাজার তৈরির জন্য রাজ্য জল নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ গঠন করুক সরকার। নতুন আইন করে স্বাধীন এই পর্ষদকে আধা-বিচারবিভাগীয় (কোয়াসি জুডিসিয়াল) ক্ষমতা দেওয়া হোক। তারাই গৃহস্থলী, কৃষি, বাণিজ্যিক, শিল্প এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে জলের দাম ঠিক করবে।
পুর এলাকায় জলের উপরে কর না বসানোর ফলে রাজ্যকে এর মধ্যে ঋণ বা বরাদ্দের টাকা পাওয়া নিয়ে ভুগতে হয়েছে। জেএনএনইউআরএম-এর কেন্দ্রীয় বরাদ্দের অন্যতম শর্তই ছিল, পুর এলাকায় জল কর চালু করা। কিন্তু রাজি হয়নি সরকার। তাতে দীর্ঘদিন আটকে রয়েছে বরাদ্দের টাকা। একই ভাবে কলকাতা পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পের (কেইআইপি) দ্বিতীয় দফার টাকা বরাদ্দের ক্ষেত্রে এডিবি-ও (এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক) জল কর নেওয়ার শর্ত দেয়। রাজ্যের গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের (আইএসজিপি) জন্য বিশ্বব্যাঙ্ক যে ঋণ দিয়েছে, সেখানে পঞ্চায়েতগুলিকে জল কর নেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায় পাইপ লাইনে জল সরবরাহ প্রকল্পে অর্থ সাহায্য করছে। তারাও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত খরচের একটি অংশ উপভোক্তাদের কাছ থেকে আদায় করতে বলেছে। মুখ্যমন্ত্রী তবু অনড়।
রাজ্যের ক্ষুদ্র সেচ মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র বলেন, “খসড়া রিপোর্ট জমা পড়েছে। জল-নীতি চূড়ান্ত হয়নি। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর মতামত না নিয়ে কিছু বলব না।” নীতি নির্ধারণ কমিটির প্রধান, সেচ সচিব টি কে ঘোষও বলেন, “দেশ ও অন্যান্য রাজ্যের অবস্থান দেখে খসড়া নীতি জমা দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত হওয়ার আগে আলোচনার অবকাশ নেই।”
কেন জল কর চাইছে কমিটি? খসড়ায় তারা বলেছে, পুর এলাকায় ৩০-৩৫% জল বাসিন্দাদের অবিবেচনা এবং দায়িত্ববোধের অভাবে নষ্ট হয়। কর চাপালে এই অপচয় বন্ধ হবে। একই ভাবে জল নির্ভর বোরো চাষ কমানো এখন জরুরি। কর বসলে এই চাষের প্রবণতাও কমবে। পাম্পের সাহায্যে ভূগর্ভ থেকে জল তোলাও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় কমিটি। সেই সঙ্গে শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও জল কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
|
পাঁচ দাওয়াই |
• পানীয় জলের দাম দিতে হবে |
• জলের দাম ঠিক করবে জল নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ |
• কর দিতে হবে সেচের জলেও |
• ভূগর্ভ থেকে জল তোলায় নিয়ন্ত্রণ |
• জল নির্ভর বোরো চাষের এলাকা কমানো |
|
|
|
|
|
|