ওই হাসি দেখলে মারতে
কারও হাত সরে
কালবোধনের পালাগান গাইতে আর ভাল লাগে না জগদীশ বিশ্বাসের।
এইটা কি ধর্মের জয় হইল বলুন? ছেলেটার লড়াইও তো ধর্মের জন্য ছিল। ওরে প্রতিজ্ঞা রাখতে দিল না!
ইছামতীর চরে বেড়িগোপালপুর থেকে সুটিয়া ছুঁয়ে যে রাস্তাটা গোবরডাঙার দিকে যাচ্ছে, সেই পথ ধরেই হাঁটা দিতেন জগদীশ। মালকোঁচা মারা ধুতি, ছেঁড়া ফতুয়া। সারা দিন অন্যের জমিতে খাটুনির পরেও তরতাজা। বেরিয়ে পড়তেন পালাগান গাইতে। দু’পয়সা উপায় হবে।
বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও পাঁচটা পেট। সব থেকে ছোট ছেলে আর মেয়েটা তো এই সে দিন হল! একাত্তরের যুদ্ধের সময়ে ফরিদপুর থেকে এ পারে এসে শূন্য থেকে জীবন শুরু পাঁচপোতায়। তার পরে সুটিয়া...
সুটিয়ার বিশ্বাসবাড়ি বাসস্ট্যান্ডের ধারে সেই ছোট ছেলেই এখন দিন-রাত হাসিমুখে তাকিয়ে।
পথচলতি লোকে থমকে তাকায়। চোখের জল মোছে। সুটিয়াবাজারে জুনিয়র গ্রুপের মণ্ডপ আলোয় ভাসে! ঢাউস কাট-আউটে সেই অমল হাসি।
সারা পুজো ঘরদোর ছেড়ে সে হাসি ঘুরে বেড়ায় সুটিয়া, পাঁচপোতা, আচারিপাড়ার মাঠে মাঠে। এই বস্ত্রদানের অনুষ্ঠান। ওই মেলায় গ্রামের বাচ্চাদের চকলেট-বেলুন বিলোনো।
ছেলে-ছোকরারা সারা ক্ষণ ওর পায়ে পড়ে! রসগোল্লা খাওয়াও। জিলিপি কই? বাড়ির ছোট ছেলে, কিন্তু ও যেন সবার বড় দাদা।
সুটিয়াবাজারের দীপ ফটোশপের শো-কেসেও সেই হাসি। অনুকূল ঠাকুর, নিগমানন্দ রায় সরস্বতীর পাশে ছেলেটার ফটো। ছেলের মা গীতাদেবী কাঁদতে থাকেন। ঘরে ঘরে আসন পেতে ওর ছবি রেখেছে। দোকান থেকে কিনছে। ওরা বলে, আমাদের বিপদেআপদে যে দেখত তারে তুলে নিলে! আর কীসের পূজা?
বড়দাদা অসিত আলমারি খুলে দেখান, মুক্তোর মত অক্ষর। নিজের হাতে ‘নির্যাতিতা বোনে’দের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র লিখেছে ভাই। এক যুগ আগের কাহিনি। সুটিয়ার ত্রাস সুশান্ত চৌধুরী, বীরেশ্বর ঢালিদের কুখ্যাত কার্গিল-পার্টির মোকাবিলায় মাথা তোলে প্রতিবাদী মঞ্চ। সম্পাদক সেই হাসিমুখ, দোহারা যুবক।
বর্ষার কাদায় গ্রামের রাস্তায় পা রাখা দায়! মাইনের টাকা উজাড় করে বালি-মাটি ফেলতে প্যান্ট গুটিয়ে নেমে পড়ল। কে বলবে, এ ছেলে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের বাংলার মাস্টার!
সুটিয়ার বাতাসে কান পাতলেই বীরগাথা। সিঙেরডাঙা থেকে একটা বুড়ি এল। খুব কাশি! ডাক্তার বলছে, ঠান্ডায় মাটিতে ঘুমোলে সারবে না।
শুনে ৫০ টাকা দিয়ে ভ্যান ডেকে নিজের খাট পাঠিয়ে দিল।
ওই যে প্রমানন্দ, শঙ্কর— সব ওর ন্যাওটা। ওর বুদ্ধিতেই পড়াশোনা, টিউশন করে চাকরি পেল। শঙ্কর চাকরি পেয়েছে ওর সাত বছর বাদে। দু’তলা বাড়ি করে ফেলেছে। আর ওর পকেট তো মাসের দশ তারিখ পেরোলেই ঢুঁ ঢুঁ। হাসতে হাসতে দাদাদের কাছে হাত পাতত।
পুজোয় কত লোককে চাদর দিত, কম্বল। বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে প্রতিবেশিনী রূপালি মণ্ডল কাঁদেন, আমার জমির রেজিস্ট্রির তিন হাজার টাকা কোথায় পেতাম! এমন ছেলে আর হবেনি গো, সাক্ষাৎ ভগবান!
কাজের শেষ নেই! থানা-পুলিশ-আদালত, নির্যাতিতাদের জীবনে ফেরানো। লড়াই চলছেই। গোবরডাঙায় যাওয়ার পথে বলদেঘাটার খাল বরাবর বেআইনি ভেড়ির দাপট। তাই ফি-বর্ষায় জনপদ ভাসায় যমুনা-ইছামতী। বাঁধ গড়ার মস্ত চ্যালেঞ্জেও সুটিয়ার সেই ভূমিপুত্র।
জিতেন বালা, ননীগোপাল পোদ্দাররা ছটফট করেন। ছেলেটার কাজ শেষ করতে হবে। কত ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ দিত। ঘরময় এখনও স্কুলপাঠ্য গণিত, পদার্থবিদ্যা, ইতিহাসের বই। ওই ছাত্রদের দেখতে হবে। তহবিল গড়া হচ্ছে। গড়ে উঠছে শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন।
ঘা-টা ঠিক কোন কায়েমি স্বার্থে লেগেছিল, ভাবতে থাকে সুটিয়া। গুলি খেয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন ননীগোপাল। এ ছেলে আর বাঁচল না। গোবরডাঙা স্টেশন-চত্বরে পিছন থেকে গুলি করল ভাড়াটে খুনি। কে জোগাল তার তিন লাখ টাকার ইনাম? মা কাঁদেন, গুলিটা পিঠে করছিল কি না! মুখটা তো দেখেনি! ওই হাসি দেখলে ওরে মারতে কারও হাত সরে!
মা-বাপ-দাদা-দিদি-পাড়াপড়শির স্বপ্নে হানা দেয়, চোখ জুড়োনো হাসি। ছবির সামনে ভাত বাড়েন মা। বেঁচে থাকতে খাওয়ার ফুরসত ছিল কই! এখন শান্তিতে খা!
উৎসবের মিলনমেলা ভেঙে গিয়েছে গাঁয়ের ভিটেয়। এই পুজোতে কলকাতার কালিকাপুরে বড়ছেলের বাড়িতে স্বেচ্ছা-বন্দি বৃদ্ধ মা-বাবা। তবু চোখে ভাসে, শরৎশেষের সুটিয়া। পথের ধারে চুড়ো-করা পাটকাঠির গাদা। তখন পাটের আঁশ ভরে আমাদের শীতের লেপ-কাঁথা জুটত। খেজুরগাছের গায়ের পর্দা পায়ে জড়িয়ে জুতো হত।
আমার ছোট ছেলে নতুন পাটের ফসল ছাড়াত ঝড়ের গতিতে। স্কুল থেকে ফিরে বিচালি কাটত বিশ গন্ডা। ঠাকুরনগর স্টেশনে ফুলের মালা বিক্রি করত। এত কষ্টেও মানুষের মতো মানুষ হইছিল বটে! বিয়ে করে নাই। সুটিয়াকেই বলত, আমার সংসার!
কালিকাপুরের বারান্দার নীচে সৌর আলোর মণ্ডপে ভিড়। আপন মনে রামায়ণের সিন্ধুবধের গান ধরেন বৃদ্ধ। এমন পুত্র যার ছেড়ে যায়, তার বেঁচে থাকা দায়। আগে লোকে যা শুনতে চাইত, গাইতাম। এখন শুধু পুত্রহারা পিতার বেদনার গান। মহীরাবণ, অহীরাবণ, তরণীসেন, বীর ইন্দ্রজিতের শোকে রাবণ, অন্ধ মুনি, দশরথের পুত্রশোক।
দেওয়ালে ছবির ফ্রেম থেকে স্মিত হাসিতে মা-বাবার চোখে চোখ রাখেন যুবক। গালে হাল্কা দাড়ি! ছবির নীচে লেখা প্রতিবাদী, আদর্শ শিক্ষক। মৃত্যুহীন বরুণ বিশ্বাস।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.