মাটির মায়ের মধ্যেই আপন মায়ের খোঁজ
প্রতি বছর মাটির মা-র চক্ষুদানের সময়, তাঁর চোখ জলে ভরে যায়। মনের মধ্যে গুমরে ওঠে অভিমান, “কেন এত ‘মা’ তৈরির পরও নিজের মা আমায় ডাকে না।” শিলিগুড়ির মাটিগাড়ার একটি ক্লাবের দুর্গা প্রতিমার শাড়ি পরাতে পরাতে চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যেও বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁর গলায় উথলে ওঠে আর্তি, ক্ষোভ, “এত মন দিয়ে প্রতিবার ঠাকুর গড়ি, মা দুর্গা কেন আমার কথা শোনেন না? দেখার সুযোগ করে দেন না মা-কে?” বাংলাকে জাতীয় ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন করা নয়ের দশকের নামী ফুটবল তারকা বন্দনা পাল। এ বারও তিনটি মাতৃ প্রতিমা গড়ছেন। কিন্তু আসল মায়ের কাছেই যে তিনি ব্রাত্য। গোবরডাঙ্গার ইছাপুরে তাঁর মা নিভারানি পালের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি বহু বছর। “বাবা মারা যাওয়ার আগে এক বার মাকে দেখে এসেছিলাম। তা-ও প্রায় বছর ছয়েক হয়ে গেল। তার পর আর দেখিনি। মা দুর্গার মূর্তি তৈরির সময় মায়ের কথা বার বার মনে পড়ে। বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে। চক্ষুদান করার পর তাঁর কাছে জানতে চাই, আমার দোষ কী? আমি তো বন্দনা পাল হয়েই বাঁচতে চেয়েছিলাম, সমাজই তো আমাকে বনি পাল হতে বাধ্য করেছে।” ফোনে কথা বলার সময়ও বোঝা যায় তাঁর গলা ধরে আসছে। ডুকরে উঠছে কান্না। গোবরডাঙ্গার বাড়ির আলমারিতে ফুটবল খেলে পাওয়া অজস্র ট্রফি, তৎকালীন রাজ্যপাল শ্যামল সেনের হাত থেকে নেওয়া সেরা মেয়ে ফুটবলারের সম্মানের ছবি সাজানো রয়েছে এখনও।
চক্ষুদান পর্ব। শিলিগুড়িতে বন্দনা। নিজস্ব চিত্র।
বন্দনার সোনালি গোলে মণিপুরকে হারিয়ে বাংলার সোনা জেতার সব পেপার কাটিং-ও। মা-কে ছুঁয়ে দেখার মতোই এগুলোকে ছুঁয়ে দেখার অধিকার থেকেও বঞ্চিত তিনি। পরিবারের বক্তব্য, “বন্দনা যে জীবন বেছে নিয়েছেন তাতে তাঁরা স্বীকৃতি দেবেন না।” কী সেই জীবন? মাসখানেক আগে অ্যাথলিট পিঙ্কি প্রামাণিক পুরুষ না নারী তা নিয়ে তীব্র বিতর্কের সময় ভেসে উঠেছিল বন্দনার নাম। পিঙ্কি রুখে দাঁড়িয়েছেন তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ খণ্ডন করতে। এখনও লড়াই চালাচ্ছেন তিনি। বন্দনা পারেননি। লুকিয়ে পড়েছিলেন! হঠাৎই বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন বাংলার ফুটবলের প্রাক্তন সোনার মেয়ে। তাঁর কথায়, “ব্যাঙ্কক এশিয়ান গেমস থেকে ফিরে আসার পর ডাক্তার বলল, তোমার ক্রোমোজোমের গণ্ডগোল আছে, মেয়েদের ফুটবলে খেলা সম্ভব নয়। তার পরই বাড়ির ও পাড়ার লোকের অত্যাচার বাড়তে লাগল। সহ্য না করতে পেরেই বাড়ি ছেড়েছিলাম।” শিলিগুড়ির মায়াদেবী ক্লাবের প্যান্ডেল এবং প্রতিমা দু’টোই বানাচ্ছেন বন্দনা। তাঁর দাবি, পুরস্কার পাবেই তাঁর সৃষ্টি। মণ্ডপের থিম, ‘সাপুড়িয়া লোক সংস্কৃতির রহস্যময় রূপকথা’। বন্দনার জীবনের ওঠা-পড়াটাও রহস্যময়। বাড়ি থেকে উধাও হয়ে কৃষ্ণনগরে প্রতিমা তৈরির কাজ শেখার সময় বন্ধুত্ব হয় স্বাতী পাল বলে একটি মেয়ের সঙ্গে। “সেই বন্ধুত্ব দেখে অনেকেই ফিসফাস শুরু করল। ভাবলাম মাঝামাঝি না থেকে একটা জীবন বেছে নিতে হবে। ডাক্তারের কাছে গিয়ে বনি পাল হয়ে গেলাম। সমাজে বাঁচার জন্যই তো এটা করতে হয়েছিল আমাকে,” অকপট এক সময়ে দেশের অন্যতম নামী স্ট্রাইকার। আর এর পরই পরিবারের কাছে ব্রাত্য তিনি। তাঁর বক্তব্য, “মা নয়, দাদা-দিদিদের জন্যই মা-কে দেখা থেকে বঞ্চিত আমি। ” ঠাকুর তৈরিই এখন বন্দনার পেশা। দুর্গা থেকে কালী মায়ের নানা রূপ গড়েন তিনি। আর আশায় থাকেন নিজের মা-কে এক বার দেখার। বন্দনার মা-ও কি একই রকম আর্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে। মেয়েকে দেখার ইচ্ছায়! কে জানে?




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.