পাকিস্তানের ঘাড় মটকে দিল ইতিহাসের ভূতই
খেলাটা এখনই শেষ হল কোথায়? কলম্বো না ভারতে? যেমন উচ্চস্বরে চক দে ইন্ডিয়া চলছে চার দিকে, যেমন নাচানাচি হচ্ছে আর চর্তুদিকে ড্রাম বাজছে, তেরঙ্গা ঝাণ্ডা দুলছে, তাতে গুলিয়ে যাচ্ছে এটা ইডেন? মোহালি? নয়াদিল্লি? না কলম্বো?
সকালে এ রকম একটা আশ্চর্য দৃশ্য দেখেছি ভারতীয় টিম হোটেলের ব্রেকফাস্ট টেবিলে। বুকি আর ম্যাচ নিয়ে কড়াকড়ির মধ্যে ভারতের এক জনও সকালে নামেননি ব্রেকফাস্ট করতে। সবার ঘরে রুম সার্ভিসের অর্ডার। নীচে এক মাত্র বিরাট কোহলি আর তাঁকে ঘিরে আইসিসির তিন জন পেয়াদা। এরা সবাই গোয়েন্দা দফতরের। ওবামা ব্রেকফাস্ট করার সময়ও ঘাড়ের কাছে এ রকম তিন জন রক্ষী থাকে কি না সন্দেহ! তা গৌতম গম্ভীর দ্বিতীয় বলে আউট হয়ে যাওয়ার পর বিরাট কোহলির জন্য ব্যাটের কাছে এমনই কিছু পেয়াদা সাজিয়ে দিয়েছিলেন মহম্মদ হাফিজ। তাতে যে লাভ হয়নি, কোহলির ৬১ বলে জ্বলজ্বল করা অপরাজিত ৭৮ তার প্রমাণ। রাহুল গাঁধীকেও ছাপিয়ে এ মুহূর্তে তিনি বিরাট কোহলি, ভারতের সবচেয়ে এলিজিবল ব্যাচেলর। উদ্ধত পিন-আপ হিরো। পাকিস্তানকে ১৮ বল বাকি থাকতে কোহলির ব্যাট আট উইকেটে ম্যাচ থেকে উড়িয়ে দিল। ম্যান অব দ্য ম্যাচ যে তাঁকেই দেওয়া হবে, পাড়ার নন্টেও জানত।
পাকিস্তান ১২৮ (১৯.৪ ওভারে)
ভারত ১২৯-২ (১৭ ওভারে)
কোহলির ব্যাট রাতারাতি একটা এসএমএস জোকের জন্ম দিয়েছে। যা ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুক, টুইটার আর বিবিএমেও ভারত সীমান্তে এক পাকিস্তানি গুপ্তচরকে দেখতে পেয়ে আর্মি অফিসার চিৎকার করলেন, ‘রুক! নেহি তো গোলি মার দুঙ্গা’। গুপ্তচর বলল, ‘সাহেব গোলিকে কোনও ভয় নেই। কোহলি হলে ব্যথা লাগত।’
তা হলে পাকিস্তানকে কোহলিই হারালেন? মোটেই নয়। পাকিস্তানের ঘাড় মটকাল ভারত-পাক ম্যাচের ইতিহাসের ভূত। সেই চেঙ্গিস খাঁ-র আমল থেকে একটা ধারণা চালু হয়েছে, পাকিস্তান নাকি টার্গেট তাড়া করতে পারে না। আর ভারত-পাক ম্যাচে নাকি আরওই নয়। তাই টস জিতেও প্রেমদাসায় ব্যাটিং। অথচ বিকেলে এবিপি আনন্দের শো করার সময় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বারবার বলছিলেন, ধোনি টস জিতলে কিছুতেই ব্যাট কোরো না। এই উইকেটে প্রথম ব্যাট করলে মরবে। সুপার এইটে এখন অবধি কোনও দল আগে ব্যাট করে জেতেনি। পাকিস্তান সেই তাৎক্ষণিক ফর্মের ইতিহাস উড়িয়ে দিয়ে কুলুঙ্গি থেকে প্রাচীন ইতিহাস বার করে এনেছিল। ১৯৯২ বিশ্বকাপের সেই সিডনি ম্যাচ থেকে গত বিশ্বকাপের মোহালি পর্যন্ত তারা নাকি পরে ব্যাট করে আর ভারতের কাছে হারে। তাদের নাকি প্রথম ব্যাট করার সময় ডিএনএ এক রকম। রান তাড়া করার সময় ডিএনএ আর এক রকম। আজ তাই চেয়েছিল পরে ব্যাট করার ঐতিহ্যকে ঘুরিয়ে দিয়ে জয়ে ফিরবে। মাথায় রাখেনি তাৎক্ষণিক ইতিহাস আর পরিবেশ ঐতিহ্যের ধার ধারে না। আগে ব্যাট করে সুপার এইটের বাকি দলগুলোর যা অবস্থা হয়েছে, পাকিস্তানেরও তাই হল। বিশ্বকাপে ভারতের কাছে কুড়ি বছর ধরে হারার পরম্পরা তারা অক্ষুণ্ণ রেখে দিল।
আবদুল কাদির গত কাল ভারতীয় টেলিভিশনে বলেছেন, পাকিস্তানের উচিত ভারতীয় দলের রাজনীতির সুযোগ নেওয়া। ভারতীয় দলে যে প্রবল অসন্তোষ চলছে, সেটা সত্যি কথা। কিন্তু সে তো অস্ট্রেলিয়া টিমেও চলছে। তাদের অধিনায়ক জর্জ বেলি সম্পর্কে ওয়ার্নার আর শেন ওয়াটসনের যা গোপন মতামত, তা ছেপে বার হলে পিটারসেনের কাহিনিকে হ্যারি পটার মনে হবে।

জয়ের পরে বিরাট। ছবি: এ এফ পি

হাফসেঞ্চুরি করে কোহলি। ছবি: এএফপি
আজ দু’টো দল পুরনো অগৌরবজনক ইতিহাস সংশোধন করার জন্য প্রেমদাসায় নেমেছিল। প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকা। তাদের প্রমাণের দায় ছিল যে, বিশ্ব পর্যায়ের টুর্নামেন্টে তারা মোটেও চোকার্স নয়। গ্যারি কার্স্টেনের মতো লাকি কোচকে ড্রেসিংরুমে নিয়েও সেই দাগ তারা মুছতে পারল না। কলঙ্কজনক বিদায় নিল আরও একটা বিশ্বকাপ থেকে। বর্ণবিদ্বেষ উঠে গেছে বহু দিন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ ফাঁড়া আর উঠছে না। পাকিস্তানেরও তেমনই। বিশ্বকাপে ভারতকে সামনে পেলে তাদের জুজু আর কাটছে না। তাদেরও এ বার চোকার্স ডাকার সময় হয়েছে।
পাকিস্তান ম্যাচে ফিরেছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। যখন গৌতম গম্ভীর বাঁ-হাতি হাসান রাজাকে রিটার্ন ক্যাচ দিয়ে গেলেন। ভারত ম্যাচ জিতলেও গম্ভীর মরমে মরে থাকবেন। স্বাধীনতার বহু পরে জন্মেও তিনি এক অদ্ভুত ভারতীয়, যিনি বিশ্বাস করেন যে, ক্রিকেট মাঠ আর কাশ্মীরের যুদ্ধটা আলাদা নয়, একই। কোহলি-সহবাগ পার্টনারশিপ অবশ্য ভারতকে দ্রুত যন্ত্রণামুক্ত করে দেয়। পাকিস্তানের নেটওয়ার্ক এক মাত্র ফিরিয়ে দিতে পারতেন সইদ আজমল। বহু পরে তাঁকে আক্রমণে এনে মহম্মদ হাফিজ সেটা হতে দেননি।
লাহৌর বিমানবন্দরের বাইরে যদি এখন থেকে তাঁর জন্য পচা ডিম আর টমেটোর তোড়জোড় শুরু হয়, আশ্চর্যের কিছু নেই। এমনিতে রোববার রাত্তিরের জাতীয় বিপর্যয়ের পরেও পাকিস্তানের জন্য অঙ্কের হিসেব খোলাই থাকল। বি-গ্রুপ থেকে এখনও সেমিফাইনাল যেতে পারে তারা। আর যদি না যেতে পারে, পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব থেকে নিশ্চিত ভাবেই অপসৃত হচ্ছেন মহম্মদ হাফিজ। আর লাহৌর এয়ারপোর্টের বাইরের লোকগুলো তো আসবেই...মিয়াঁদাদ-আক্রমকে পর্যন্ত তারা ছাড়েনি। অতীতে কলকাতা নাইট রাইডার্স সমর্থকদের একাধিক রাত্তির নষ্ট করে দিয়েছেন হাফিজ। আজও ২৮ বলে ওপেন করে ১৫ রান তাঁর দেশকে শুরুতেই জাতীয় শোকের দিকে ঠেলে দিল। নারকীয় অপরাধ বললে এতটুকু অত্যুক্তি হয় না। তুমি ওপেনার, প্রথম পাওয়ার প্লে-তে ব্যাট করার সুযোগ পাচ্ছ, তা-ও অধিনায়ক। একটা বাউন্ডারি বাদ দিলে করেছ ২৭ বলে ১১! ভারত-পাক ম্যাচে ১৬ ডট বল মানে গাওস্করের সেই ৬০ ওভারে অপরাজিত ৩৬ অবধি লজ্জায় মুখ লুকোবে!

আফ্রিদিকে ফিরিয়ে বালাজি। ছবি: রয়টার্স
ভারত-পাক ম্যাচের পাহাড়প্রমাণ ম্যাচে চোক করে গেলেন? নাকি টিম স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী এক দিক ধরতে গিয়ে বেশি ধরে ফেলেছিলেন?
মনে হয় প্রথমটা। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বিপক্ষ অধিনায়ককে সচরাচর স্নায়ুর চাপে কম্পিত দেখা যায় না। অথচ আজ প্রথম ওভারে মনে হচ্ছে সহজ হাতের বল গ্লাভস ঠিকরে ফেলে দিচ্ছেন! জাহিরের প্রথম বলটাই ধোনি যে ভাবে বাই-চার দিলেন, স্কুল ক্রিকেটেও ঘটলে ক্যাপ্টেন অনিবার্য ভাবে একটা কড়া চাউনি কিপারকে দেবে। খেলার পর ধোনি আনন্দবাজারকে বলছিলেন, “এখনও অবাক লাগছে কী করে পা নিয়ে গিয়েও বলটা পেলাম না!” এর পর আর একটা বলও ধোনি গ্লাভসে জমাতে পারলেন না। পুরনো দিনে এমন হলে কিপার খেলা থামিয়ে ইনার গ্লাভসটা ভিজিয়ে নিত। তখনকার ক্রিকেটে একটা বিশ্বাস ছিল, ভিজে ইনার থাকলে কিপিং গ্লাভসে বল জমে ভাল। আধুনিক গ্লাভসের মানে এত উন্নতি হয়েছে যে আর ইনার ভেজানোর প্রয়োজন পড়ে না। ইনার ভেতরের সাদা দস্তানাটা, যা ধোনি সে দিন বলছিলেন, জন্মেও ভেজাননি। কিছু পরে ভারত অধিনায়ক আউটফিল্ড থেকে আসা থ্রো ধরতে না পেরে সহজ রানআউটও মিস করলেন।

যুবরাজের হুঙ্কার।
ছবি: এএফপি
বোঝা গেল টেনশন আজ তথাকথিত বরফশীতল ভারত অধিনায়ককেও গিলে ফেলার উপক্রম করছে।
যুবরাজ সিংহ ম্যাচের দ্বিতীয় বলে ডাইভ দিয়ে যে নিশ্চিত চারটা বাঁচালেন, প্রেমদাসায় সেটা তাঁকে ধরতে দেখেছি দশ বছর আগের মিনি ওয়ার্ল্ড কাপে। জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, “রোলার স্কেটিং করতাম ছোটবেলায়। ডাইভ দেওয়াটা আমার কাছে কোনও ব্যাপারই নয়।” আজ তাঁকে ডাইভ দিয়ে বল বাঁচাতে দেখে মনে হল, কেমোথেরাপি নেওয়া তিনি তার মানে ঠিক করে নেমেছেন, প্রেমদাসায় আজ প্রাণ যায় যাক, ক্রিকেটীয় মর্যাদাকে আর মরতে দেব না। এ বারের সফরে ওয়ার্ম আপ ম্যাচেও দেখিনি যুবরাজকে ডাইভ দিতে। কিন্তু আজ অন্যরা খেলছে ভারত-পাক ক্রিকেট। তিনি যুবরাজ সিংহ খেলছেন জীবনের ম্যাচ!
দু’উইকেট ৩৫ রানে হারিয়েও পাকিস্তান লড়াইয়ে ছিল। তখনও তাদের রান রেট আট করে যাচ্ছে। পাওয়ার প্লে শেষ হওয়া মাত্র আক্রমণে আসা যুবরাজ তাদের ইনিংসের মাজা ভেঙে দিলেন। মমতা আর মনমোহনে এখন যা সম্পর্ক, যুবরাজ আর ধোনিতে মোটামুটি তাই। ওহো, ভুল লিখলাম। মমতা-মনমোহন সামান্য ভাল। অদৃষ্টের পরিহাস, দুটো ক্যাচই তাঁর বলে কট বিহাইন্ড। ধোনি ক্যাচ নিলেন। যুবরাজ আবার ডিরেক্ট থ্রো-তে একটা রান আউটও করলেন।
ডাভ হোয়াটমোর একটা মরিয়া চেষ্টা করেছিলেন আফ্রিদিকে সুইসাইড বম্বারের মতো তিন নম্বরে পাঠিয়ে। কিন্তু এটাও তো সেই ইতিহাসের ভূত ঘাড়ে নিয়ে স্ট্র্যাটেজি করা। আফ্রিদির ফর্ম কোথায় এমন তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জের জবাব দেওয়ার মতো? গত দশ ইনিংসে সব রান পিন কোড সংখ্যার মতো। এ দিন সামান্য ভাল ১২ বলে ১৪। কামরান আর উমর আকমল ভাইয়েরা পরে ব্যাট করলে হয়তো অনেক নিশ্চিন্তে টার্গেট তাড়া করার সুযোগ পেতেন। কিন্তু শুরুর দিকে চারটে উইকেট। ওই চাপ, না জানা টার্গেট পুরো ব্যাটিংটাই স্লো মোশনে চলে গেল।
ভারতীয় ফিল্ডিং সম্পূর্ণ রূপান্তরিত ছিল আজ ঝকঝকে আউটফিটে। অধিনায়কের মৃদু চোকিং তারা ঢেকে দিল তারুণ্যের জোশে। এই ভারত বহু দিন অদৃশ্য ছিল। আবার কি পাক-ভারত ম্যাচ খেলার পরশপাথরই জাগিয়ে দিল ধোনির টিমকে? ঝিমিয়ে পড়া ভারতের কি এখন তা হলে পাকিস্তানকে খুঁজেপেতে আনা উচিত রেডিমেড মঙ্গলের জন্য?
টিম ইন্ডিয়ার লাকি ম্যাসকট কি তা হলে পাকিস্তান হয়ে দাঁড়াল? অপেক্ষা আর দু’দিনের। মঙ্গলবার রাতে ভগ্ন দক্ষিণ আফ্রিকা চূড়ান্ত জবাব দেবে!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.