তারকেশ্বরের চাষি বিনোদ দাস এখন কপাল চাপড়াচ্ছেন। তিন সপ্তাহ আগেও তাঁকে বেগুন বিক্রি করতে হয়েছে প্রতি কেজি ১২ টাকা দরে। এখন সেই দর তিরিশের ঘর ছুঁলেও অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এ মরসুমে আর লাভের মুখ দেখা হবে না বিনোদবাবুর। আট কাঠা জমিতে বেগুন চাষ করে এখন তাঁর গলায় হতাশা, “ফড়েরা দামই দিল না। জলের দরে সব বেচে দিলাম। চাষের খরচ উঠবে কী করে!”
বিনোদবাবু কোনও বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নন। প্রায় সারা রাজ্যের চাষিই সব্জি ফলিয়ে হাত কামড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। রোজ বাজারে গিয়ে কলকাতার মানুষ যখন আগুন দামে সব্জি কিনছেন, তখন কিন্তু তার ছিটেফোঁটাও ঢুকছে না চাষির ঘরে।
কেন? চাষিরা দায় চাপাচ্ছেন ফড়েদের উপরে। বলছেন, তাঁদের কাছ থেকে নামমাত্র দামে সব্জি কেনে ফড়েরা। সেটাই যখন তিন-চার হাত ঘুরে শহরের বাজারে পৌঁছয়, দাম বেড়ে যায় দ্বিগুণ-তিন গুণ। অর্থাৎ, ক্রেতার পকেট থেকে টাকাও গেল, আবার চাষিও লাভ পেলেন না।
ফড়েরাজ থেকে চাষিদের বাঁচাতে সুরাহার খোঁজে নেমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ঝুলি থেকে বের করেছে সেই পুরনো তত্ত্ব। নিয়ন্ত্রিত বাজার। বাম আমলে যার নাম ছিল রেগুলেটেড মার্কেট, এখন তার নাম হয়েছে কিষাণ মান্ডি। তবু প্রশ্ন উঠেছে, সমস্যা আদৌ মিটবে কি?
এই প্রশ্নের পিছনে রয়েছে বাম আমলের অভিজ্ঞতা। তাদের রেগুলেটেড মার্কেটের ভরাডুবি হয়েছিল। তার পরেও যখন নতুন সরকার নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন বাজারের পরিকল্পনা নিয়ে নামল, ভুরু কুঁচকেছেন অর্থনীতির শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট লোকেরা। তাঁদের প্রশ্ন, বাজার চালানো কি সরকারের কাজ? পুরনো অভিজ্ঞতা থেকে যেখানে স্পষ্ট, এমন প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে, তখন সেই পথে আবার হাঁটতে গেল কেন নতুন সরকার? তাঁদের বক্তব্য, রেগুলেটেড মার্কেটের বদলে যে কিষাণ মান্ডি তৈরির কথা ভাবছে সরকার, তাতে সুরাহা দুর অস্ত। কৃষি দফতরের এক কর্তার কথায়, “এ যেন আরও চটকদার বোতলে সেই একই মদ!”
কেমন ছিল বাম সরকারের নিয়ন্ত্রিত বাজার? চাষিদের ন্যায্য দাম পাইয়ে দিতে সারা রাজ্যে মোট ৪৩টি রেগুলেটেড মার্কেট তৈরি করা হয়। ব্যবস্থা করা হয় যাতে সরাসরি সব্জি বেচতে পারেন চাষিরা এবং ন্যায্য দাম পান। যাতে তাঁদের ফড়েদের পাল্লায় পড়তে না হয়। কিন্তু কার্য ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, যে লক্ষ্যে ওই সমস্ত বাজার তৈরি করা হয়েছিল, নজরদারির অভাবে সেই উদ্দেশ্যই মাঠে মারা গিয়েছে। চাষিরা রয়ে গিয়েছেন সেই ফড়েদের কব্জাতেই। |
তাই সরকারি কর্তাদের একাংশের মতে, “ফড়েদের হাত থেকে চাষিদের বাঁচাতে যে নিয়ন্ত্রিত বাজার গড়ার পরিকল্পনা হয়েছিল, তাতে ফড়েরাজ বিন্দুমাত্র কমেনি। কার্যত একই পথে হেঁটে তৃণমূল সরকারও কিষাণ মান্ডি নামের আর একটি নিয়ন্ত্রিত বাজার তৈরির পরিকল্পনা করেছে।”
কেমন হবে তৃণমূল সরকারের এই নতুন প্রকল্প?
ক্ষমতায় এসেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, রাজ্যের সব ব্লকে (৩৪১টি) একটি করে কিষাণ মান্ডি গড়ে তোলা হবে। পরবর্তী কালে সেই সংখ্যা কমিয়ে সরকার ৯২টি বাজার তৈরির পরিকল্পনা করে। কৃষি দফতর সূত্রের খবর, বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে এতগুলোও তৈরি করা সম্ভব নয় বুঝে আপাতত ১৬টি ব্লকে কিষাণ বাজার তৈরির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে কৃষি বিপণন দফতর। প্রকল্পের রূপরেখা অনুযায়ী, চার থেকে পাঁচ একর জমিতে ওই বাজার গড়ে উঠবে। নিলামে সব্জি কেনাবেচার জন্য সেখানে একাধিক ‘অকশন প্ল্যাটফর্ম’ থাকবে। চাষিরা নিজেদের খরচে জমির ফসল নিয়ে এসে ওই প্ল্যাটফর্মে জমা করবেন। সেখানেই সব্জি নিলাম হবে।
কতটা এগিয়েছে প্রকল্প? সরকারি সূত্রের খবর, টাকার অভাব তো আছেই, তা ছাড়া জমি-জটেও আটকে রয়েছে কাজ। বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমান বাজার দরে একটি কিষাণ বাজার তৈরি করতে সওয়া ৫ কোটি টাকা লাগবে। অর্থাৎ, ১৬টিতে খরচ ৮০ কোটিরও বেশি। কিন্তু টাকা কই? এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনায় ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে ওই প্রকল্পে। বাকি টাকা গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়ন তহবিল থেকে জোগাড় করার কথা। মাস সাতেক আগে কিষাণ বাজার তৈরির জন্য দরপত্র চেয়েছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু কোনও সাড়া না মেলায় কিছু শর্ত নরম করে ফের দরপত্র হাঁকার প্রস্তুতি চলছে।
অর্থাৎ শুরুতেই হোঁচট খেতে খেতে এগোচ্ছে কিষাণ বাজার তৈরির কাজ। কিন্তু কেন?
রাজ্যের এক অর্থনীতির শিক্ষক জানান, সরকার যদি বাজার তৈরি করতে যায় তা হলে এমনই হবে। তিনি বলেন, “সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শিক্ষা নিয়ে চিনও এখন বাজার অর্থনীতির পথে হাঁটতে শুরু করেছে। অথচ এ রাজ্য এখনও সেই পুরনো ধারণা আঁকড়েই চলছে।” ফল? বহাল তবিয়তে কায়েম থাকবে সেই ফড়েরাজ। কৃষি বিপণন দফতরের এক কর্তা বলেন, “ফড়েদের কথায় পাইকাররা যদি একজোট হয়ে নিজেদের সুবিধামতো সব্জির দাম বেঁধে দেয়, তা হলে শত নিলাম করেও চাষিরা তা বাড়াতে পারবেন না। পাইকার বাজারে এখন এমনটাই চালু রয়েছে।”
কিষাণ মান্ডি নিয়ে চাষিদেরও সংশয় রয়েছে। বসিরহাটের মহম্মদ আকবর বলছেন, “কিষাণ বাজার হলেও আগের মতো ফড়েদের চক্রই নিলাম নিয়ন্ত্রণ করবে। চাষিদের সেই দামেই সব্জি বিক্রি করতে হবে।”
যে জেলার চাষি মহম্মদ আকবর, সেই জেলাতেই কিন্তু বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো রয়েছে একটি গ্রাম। পূর্ব খিলকাপুরের জয়পুর। সেখানকার ২৪ ঘর চাষি সব্জি বেচেন মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি-কে। তাতে নিজেরা পাচ্ছেন ন্যায্য মূল্য, দূর হটেছে ফড়েরাজ। তারকেশ্বরের বিনোদ দাসের মতো জয়পুরের আজগার আলিরও আট কাঠা জমি। গত মরসুমে সেখানে মুলো ফলিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বেচতে পারেননি। মাঠেই পচেছিল সব। এ বার মেট্রোর দৌলতে বদলে গিয়েছে ছবি। আর পকেটে টাকা আসায় পাল্টে গিয়েছে চাষিদের জীবনযাত্রাও।
তা হলে? বিনোদ দাসরা এখন বলছেন, “দেশি না বিদেশি পুঁজি, তা জানি না। গ্রামে বড় কোম্পানি এলে ফড়েদের জুলুম থেকে চাষিরা রক্ষা পাবে। চাষিদের স্বার্থেই তাদের আনা উচিত।” দেশীয় কিছু সংস্থা এখন চাষিদের কাছ থেকে কিনে নিজেদের স্টোরে সব্জি বেচে। তবে সংখ্যায় তা খুব বেশি নয়। অনেক চাষিই এখন বলছেন, দেশি ফুডবাজার, স্পেনসার্সের সঙ্গে বিদেশি ওয়ালমার্ট এলে ভাল, তাজা সব্জি তুলে নিতে প্রতিযোগিতা বাড়বে। “তারা সরাসরি আমার কাছে আসবে, আমি পয়সা পাব,” বলছেন চাষিরা।
আর ফড়েরা? উৎখাত হলে তাঁরা কি বেকার হয়ে পড়বেন না?
উত্তরে কৃষি বিপণন দফতরের এক কর্তা বলেন, “বড় পুঁজি এলে তারা কাদের নিয়ে কাজ করবে? এত দিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ফড়েরাই তখন তাদের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠতে পারেন। ফড়েরা চাইলেই বড় সংস্থাগুলি তাঁদের লুফে নেবে।”
তবু মমতা বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির দরজা বন্ধ করে রেখেছেন খিল এঁটে। আজ, সোমবার দিল্লির যন্তর মন্তরে বক্তৃতা দেবেন এর বিরুদ্ধে। দিল্লি থেকে অনেক দূরে, তারকেশ্বরে বসে বিনোদ দাসরা কিন্তু বলছেন, খিলটা খুলুন। তা হলে আমরা বাঁচি! যেমন বাঁচছেন আজগার আলিরা। |