ক্যুরিয়ারের প্যাকেট খুলতেই নিমেষে প্রলয়
তীব্রতায় ছিল মালদহের থেকে বেশি
মিস মার্পল-এর স্রষ্টা আগাথা ক্রিস্টি পার্সেল-বোমা বা বই-বোমার পটভূমিকায় কোনও গল্প-উপন্যাস লিখে যাননি। কিন্তু বাংলায় অনূদিত তাঁর গোয়েন্দাকাহিনি সঙ্কলনেরই একটি বাঁধানো বইয়ের ভিতরে বিস্ফোরক ভরে তা ব্যবহার করা হয়েছিল বোমা হিসেবে, প্রায় দেড় বছর আগে যার বলি হয়েছিলেন মালদহের স্কুলশিক্ষিকা অপর্ণা বিশ্বাস।
ইংরেজবাজারের মালঞ্চপল্লির বাসিন্দা অপর্ণাদেবীর নামে ক্যুরিয়ার মারফত পার্সেল পাঠানো হয়েছিল। বুধবার হাওড়ার বাকসাড়ার চৈতালি সাঁতরাও ক্যুরিয়রেই পার্সেল পেয়েছিলেন। যা খুলতেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ। পশ্চিমবঙ্গে এই নিয়ে দ্বিতীয় পার্সেল-বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল।
মালদহ-কাণ্ডের পিছনে গোয়েন্দারা এক যুবকের ‘ব্যর্থ প্রেম’কে চিহ্নিত করলেও হাওড়ার ক্ষেত্রে ‘আরও গুরুতর’ কোনও কারণ থাকতে পারে বলে তদন্তকারীদের সন্দেহ। তাঁদের বক্তব্য, চৈতালিদেবী দিল্লির এক হিন্দি সাপ্তাহিক সংবাদপত্রে লেখালেখি করতেন। সংবাদপত্রটির সঙ্গে তিনি যুক্ত হন মাস চারেক আগে। পাশাপাশি মানবাধিকার সংগঠন ‘কমিটি ফর প্রোটেকশন অফ ডেমোক্র্যাটিক রাইটস (সিপিডিআর)’-এর হয়েও তিনি কাজকর্ম করতেন। গোয়েন্দাদের একাংশের অনুমান, সংবাদপত্রে বিশেষ কিছু লেখার জেরে চৈতালিদেবী কারও তীব্র আক্রোশের মুখে পড়েছিলেন। অথবা এমন স্পর্শকাতর কোনও নথি তাঁর হাতে চলে এসেছিল, যা দিয়ে কারও স্বার্থহানি ঘটানো যেত। দু’ক্ষেত্রেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার মতো জোরালো ‘মোটিভেশন’ থাকতে পারে বলে গোয়েন্দাদের এই মহলের অভিমত।
এই অভিমুখে তদন্তে কী ভাবে এগোচ্ছে?
গোয়েন্দা-সূত্রের খবর: গত জুনে ডোমজুড়ের এক হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের গ্রেফতারে হাওড়া জেলা পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়তা’র অভিযোগ তুলে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন চৈতালিদেবী। এর সঙ্গে এ দিনের ঘটনার যোগ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দিল্লির সংবাদপত্রটির মালিক সংস্থার সঙ্গেও যোগাযোগ করছে পুলিশ। পাশাপাশি দেখা হচ্ছে, সত্যি কোনও ক্যুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেই পার্সেলটা পাঠানো হয়েছিল, নাকি ক্যুরিয়ারের নাম করে আততায়ীরা নিজেরাই চৈতালিদেবীর বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল তাঁর মৃত্যু-পরোয়ানা। পুলিশের ধারণা, মহিলার কাছে প্রায়শই ক্যুরিয়ারে পার্সেল আসত, দুষ্কৃতীরা যার সুযোগ নিয়েছে। এক পুলিশকর্তা বলেন, “পার্সেলটি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ছিল একটা পত্রিকার মতো। বিমানে না-আসারই সম্ভাবনা, কারণ তা হলে তল্লাশিতে ধরা পড়ে যেত। হতে পারে, এ রাজ্যেই কোথাও সেটি তৈরি করা হয়েছে। বাইরে তৈরি হয়ে থাকলেও রেল বা সড়কপথে পাঠানো হয়েছে।”

পার্সেল বোমা কী?
এক ধরনের ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আই ই ডি), পার্সেল খুললেই বিস্ফোরণ। ইতিহাস
বিদেশে
১৭৬৪ সম্ভবত প্রথম বিস্ফোরণ ডেনমার্কে।
১৯৩৯ লন্ডন, বার্মিংহাম, ম্যাঞ্চেস্টারের ডাকঘর, ডাকবাক্সে বিস্ফোরণ।
১৯৬১ নাৎসিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল মোসাদ।
১৯৭০ প্যালেস্তাইনি জঙ্গিরা সুইস এয়ার ৩৩০-এ বিস্ফোরণ ঘটায়, হত ৩৮।
১৯৭২ লন্ডনে বিস্ফোরণে নিহত এক ইজরায়েলি কূটনীতিক।
দেশে
১৯৯৫ শ্রীনগরে পার্সেল বোমায় নিহত
চিত্র সাংবাদিক মুশতাক আলি।
২০০৪ জম্মু ও কাশ্মীরে বোমা উদ্ধার।
২০০৬ তিরুঅনন্তপুরমে বিস্ফোরণ, উদ্ধার আর একটি বোমা।
২০১০ দিল্লির কাছে জামিয়া মিলিয়া নগরে বিস্ফোরণ।
২০১১ মালদহে পার্সেল বোমায় স্কুলশিক্ষিকা নিহত।
২০১২ হাওড়ায় বিস্ফোরণে হত
ফ্রিলান্স সাংবাদিক, আহত স্বামী।

তবে বিস্ফোরণের তীব্রতার নিরিখে মালদহকে বহু পিছনে ফেলে দিয়েছে হাওড়া। কী রকম?
পুলিশ জানাচ্ছে, মালদহে বই-বোমা বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া খুব বেশি হয়নি। যে টেবিলের উপরে সেটা রাখা হয়েছিল, তার একটা অংশ উড়ে যায়। এমনকী, ওই ঘরের কাচের আলমারিরও কোনও ক্ষতি হয়নি। কিন্তু হাওড়ায় বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া হয়েছে সাংঘাতিক। এ দিন চৈতালিদেবীর বাড়ির একশো মিটার দূরের বাড়িও বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছে। অর্থাৎ অল্প পরিমাণে মজুত অতি তীব্র বিস্ফোরকই সৃষ্টি করেছে ওই প্রচণ্ড অভিঘাত। হাওড়া কমিশনারেটের এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “মনে হচ্ছে, গোটা পার্সেলটাই ছিল বিস্ফোরকে ঠাসা। তা আড়াল করা ছিল কাগজপত্র বা ওই রকম কিছু দিয়ে। তাতেই ফল হয়েছে মারাত্মক।”
কী ধরনের বিস্ফোরক হতে পারে?
অফিসারটি বলেন, “মালদহে মূলত পটাসিয়াম নাইট্রেট ব্যবহার করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বা ওই জাতীয় কিছু হতে পারে। সঙ্গে অন্য রাসায়নিকও হয়তো ছিল। আরডিএক্স না-হওয়ারই সম্ভাবনা।” গোয়েন্দাদের মতে, আরডিএক্স থাকলে বাড়িটার বড় অংশ মাটিতে বসে যেত (ইমপ্লোশন)।
আপাতত এ ব্যাপারে ফরেন্সিক-রায়ের অপেক্ষায় রয়েছেন তদন্তকারীরা। মালদহে বই-বোমা বিস্ফোরণের পরে উদ্বিগ্ন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ভিআইপি-নিরাপত্তা সংক্রান্ত একগুচ্ছ সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিল রাজ্যে-রাজ্যে। ভিআইপি’দের বাড়ি-অফিসে মোতায়েন নিরাপত্তারক্ষীদের পার্সেল-বোমা চিহ্নিতকরণের বিশেষ প্রশিক্ষণ, পার্সেল রাখার আলাদা জায়গা তৈরি, পত্রবোমা ধরতে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার ইত্যাদিতে জোর দেওয়া হয়।
এ দিন অবশ্য পার্সেল-বোমার শিকার হলেন ফের এক সাধারণ মানুষই।

এই সংক্রান্ত আরও খবর
পার্সেলে কী যাচ্ছে, পরোয়াই করে না ডাক বিভাগ



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.