অনুপ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
একে নিজেদের পরিকাঠামো নেই। তার উপরে মশাবাহিত রোগ রুখতে যে সুপারিশ করেছিলেন বিশেষজ্ঞেরা, মানা হয়নি তা-ও। আর তারই মাসুল গুনে এখন সল্টলেক ও লাগোয়া এলাকায় কার্যত মহামারীর আকার নিয়েছে ডেঙ্গি।
বিধাননগরে ডেঙ্গির এই হারে ছড়িয়ে পড়া আটকাতে এ বারও কলকাতা পুরসভার সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ বলেন, “বিধাননগর পুরসভার চেয়ারম্যানের অনুরোধে গত এপ্রিলে কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ দল ওই পুর-এলাকায় গিয়ে মশার লার্ভা নিধনের কাজ করেছে। ওদের স্বাস্থ্য দফতরের কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণও দিয়েছে।” কলকাতা পুরসভার এক পতঙ্গ-বিশেষজ্ঞ জানান, মশার উপদ্রব কমাতে সেখানে একটি ‘ভেক্টর কন্ট্রোল ইউনিট’ গড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এক জন পতঙ্গবিদকে নিয়োগ করার কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই পরামর্শ মানা হয়নি বলে বিধাননগর পুরসভা সূত্রেই খবর। একই সঙ্গে পুর-আধিকারিকেরা মেনে নিচ্ছেন, মূলত পরিকাঠামোর অভাবেই এ বার এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গি।
সম্প্রতি ডেঙ্গি নিয়ে স্বাস্থ্য ভবনের এক বৈঠকে মশাবাহিত রোগ ঠেকাতে বিধাননগর পুরসভার পরিকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন স্বাস্থ্যসচিবও। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, বৈঠকে উপস্থিত অফিসারদের সামনেই স্বাস্থ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র বলেন, “বিধাননগর পুরসভায় মশা নিধনের উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যা হয়েছিল।” |
মশা-নিধন কর্মসূচি নিয়ে বিধাননগর পুরসভাকে এ ভাবেই বিঁধল কংগ্রেস।
সল্টলেকের পথে টাঙানো হয়েছে এই ব্যানার। মঙ্গলবার। —নিজস্ব চিত্র |
খোদ বিধাননগর পুরসভার উপ-পুরপ্রধান সব্যসাচী দত্ত বলছেন, “বিধাননগরের চার দিক খাল দিয়ে ঘেরা। ভিতরে খোলা নর্দমার কোনও ব্যবস্থা নেই। যত্রতত্র জল জমে থাকে। ওই জমা জলে কী মশা জন্মাচ্ছে, তারা কতটা বিপজ্জনক, এ সব দেখার জন্য কোনও বিশেষজ্ঞ নেই। কেবল মশার তেল দিয়েই খালাস।” পুরসভা সূত্রের খবর, এখানে স্বাস্থ্য দফতর দেখেন দু’জন স্যানিটারি ইনস্পেক্টর। মশার উপদ্রব নিয়ে কোনও এলাকা থেকে অভিযোগ এলে সেখানে প্রথমে ব্লিচিং পাউডার ছেটানো হয়। পরে তেল ছড়ানোর ব্যবস্থা হয়। সব্যসাচীবাবুর কথায়, “ওই তেল কাজ করছে কি না, তা পরীক্ষা নিরীক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেই। ফলে মশা দমন হচ্ছে কি না, তা জানাও যাচ্ছে না।”
আতঙ্কিত এলাকাবাসীর বক্তব্য, মশার প্রকোপ রুখতে বাম ও তৃণমূল দুই বোর্ডই ব্যর্থ। কোনও বোর্ডই মশা-দমনকে অগ্রাধিকার দেয়নি। অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছেন বিধাননগর পুরসভার একাধিক চেয়ারম্যান পারিষদও। তাঁদের কথায়, ২৫টি ওয়ার্ডে প্রায় দু’হাজার মানুষ এ বার ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন। অন্য দিকে, তৃণমূল-পরিচালিত পুর-বোর্ডের সমালোচনায় কংগ্রেস দলের প্রচার ‘বিধাননগর পুরসভার ডেঙ্গি প্ল্যান মশাকে সম্মান করুন।’ কংগ্রেসের এই তির্যক সমালোচনা যে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তা ধরা পড়েছে পুরসভারই এক অফিসারের বক্তব্যে। তাঁর কথায়, “অতীতে কখনও এ ভাবে ডেঙ্গির প্রকোপ দেখা যায়নি”
তবে, গত বাম বোর্ডের বিশ্বজীবন মজুমদার বলেন, “আমাদের আমলে মশা-নিধনে ধোঁয়া দেওয়ার যন্ত্র ছিল। তা কাজেও লাগানো হত।” সিপিএমের কমিশনার তথা বিধাননগর পুরসভার বিরোধী দলনেত্রী ইলা নন্দীরও বক্তব্য, “আমরা আগে ধোঁয়া ছড়াতাম। এখন শুনছি বর্তমান বোর্ড বলছে, যন্ত্রগুলিই খারাপ, তাই ধোঁয়া ছড়ানো হয়নি।” তৃণমূলের চেয়ারম্যান পারিষদ অশেষ মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “উনি কোথা থেকে খবর পেয়েছেন জানি না। এ বারও আমরা মশা-নিধনে ধোঁয়া দিয়েছি। তবে মাত্র চারটি যন্ত্র রয়েছে, যা হয়তো দরকারের তুলনায় কম। ”
বিধাননগর পুরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণা চক্রবর্তী বলেন, “বিধাননগরের অনেক বন্ধ থাকা বাড়িতে, সরকারি অফিসে জমে থাকা জলে ডেঙ্গিবাহী এডিস মশার লার্ভা মিলেছে। সেখান থেকেই ডেঙ্গি ছড়িয়েছে।” তিনি জানান, বিধাননগরে অনেক বাড়িতেই ফুলের টব রয়েছে। সে সবই ওই প্রজাতির মশার আঁতুড়ঘর। এ নিয়ে বারবার মানুষকে সচেতন করা হলেও অনেকেই শোনেননি। তাঁর কথায়, “মানুষ সচেতন না হলে একা পুরসভার কিছু করার নেই।” |