চাপমুক্ত মনই অনিদ্রার ওষুধ ঘুম না-আসার চিন্তায় ঘুম খুন
র একটু চোখ বুজে থাকি, ওই তো সে আসছে।...নাহ্ সে আর এল না। প্রতিদিন রাতে গোটা বিশ্বের কয়েক কোটি বাড়িতে একটু কান পাতলেই এমন দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাওয়া যাবে। আর যার জন্য এত হা হুতাশ, সে আর কেউ না, একটু ঘুম।
কিন্তু ঘুম আসে না কেন?
এ পর্যন্ত কয়েক লক্ষ বই প্রকাশ হয়েছে অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া নিয়ে। কোনও শারীরিক বা মানসিক কারণে সাময়িক ঘুমের ব্যাঘাত কিন্তু অনিদ্রা নয়। বেশ কয়েক মাস ধরে যদি একই অবস্থা চলতে থাকে সেটাকেই শারীরবিদেরা বলে থাকেন অনিদ্রা রোগ বা ইনসমনিয়া। অনিদ্রা রোগের অবসানে পশ্চিমের দেশগুলিতে এত দিন দাওয়াই ছিল গুচ্ছ গুচ্ছ ঘুমের ওষুধ। যাদের বেশির ভাগই শরীরের বিভিন্ন স্নায়ুকে নিস্তেজ করে দিয়ে ঘুম নিয়ে আসত।
কিন্তু আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ’-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, অনিদ্রার অবসান ঘটাতে পারেন রোগী নিজেই। কী ভাবে? দুশ্চিন্তা কমিয়ে, মনকে আনন্দে রাখলেই অনিদ্রা কেটে যেতে পারে বলে দাবি করেছেন গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, “আপনি যে অনিদ্রার রোগী সেটা মন থেকে মুছে ফেলুন। নিজেকে চাপমুক্ত রাখুন। তা হলেই মুক্তি মিলবে ওই রোগ থেকে।”
ওই সমীক্ষা বলছে, মার্কিন মুলুকে প্রতি ১০ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে এক জন ইনসমনিয়ার শিকার। এঁদের বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, প্রথমে চিন্তা আর মানসিক অবসাদ থেকেই ঘুম কমে গিয়েছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে মনের উপরে চাপ অত্যাধিক চাপ পড়ছে। পরদিন কী হবে সেই চিন্তায় রাতে ঘুম আসছে না। অমন ক’দিন চলার পরে রাতে শোয়ার সময়ে কেবলই মনে হচ্ছে, ঘুম আসবে না। ঘুম কেন আসছে না সেই চিন্তায় রাতের পর রাত জেগে কাটিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। শিকার হচ্ছেন ইনসমনিয়ার। শেষে একটু ঘুমোনোর তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ঘুমের ওষুধে আসক্ত হয়ে পড়ছেন।
আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ’ (এনআইএইচ)-এর গবেষকরা বহু বছর ধরে ইনসমনিয়া নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, অনেকেই ইনসমনিয়ার রোগী বলে তাঁদের কাছে আসেন। গবেষণাগারে ঘুমোতে বলা হয় তাঁদের। সেই সময়ে তাঁদের মস্তিষ্কে ভিতরে কী পরিবর্তন হচ্ছে তা তরঙ্গে আকারে একটা পর্দায় ধরে রাখা হয়। সেই তরঙ্গ পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, অনেক সময়ে পরীক্ষা শুরু হওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেও রোগীরা দাবি করছেন, তাঁদের ঘুম আসতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগছে। আবার কয়েকটি ক্ষেত্রে রোগীরা দাবি করছেন, তাঁরা একদমই ঘুমোননি। যদিও তরঙ্গ অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, বেশ কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন তাঁরা।
গবেষকেরা জানাচ্ছেন, অনিদ্রার স্বল্প মেয়াদি স্মৃতিই এর জন্য দায়ী। অনেক সময়েই মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে ঘড়িতে ক’টা বাজে দেখা বা ঠান্ডা লাগছে বলে গায়ে চাদর টেনে নেওয়ার মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটে। সেটাই মস্তিষ্কের স্মৃতি কেন্দ্রে অস্থায়ী ছাপ ফেলে। ওই ব্যক্তি ভাবেন, তিনি রাতে আদৌ ঘুমোননি। এই নিয়ে মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকেন। আর তখনই আসরে নামে ঘুমের ওষুধ। ওই চিকিৎসকের মতে, বিভিন্ন ঘুমের ওষুধ এই স্বল্প মেয়াদি স্মৃতি তৈরি হতে দেয় না। ফলে রাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে গেলেও রোগীর সেই কথা মনে থাকে না। বরং তিনি মনে করেন, সারা রাত একটানা ঘুমিয়েছেন তিনি। শুধু ২০১০ সালেই আমেরিকায় বিক্রি হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকার ঘুমের ওষুধ।
কিন্তু গবেষকরা জানাচ্ছেন, সাময়িক উপকার করলেও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে ঘুমের ওষুধ ইনসমনিয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারে না। কিউবেকের লাভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজির অধ্যাপক চার্লস মরিন ১০ বছর ধরে ইনসমনিয়া রোগীর উপরে ঘুমের ওষুধের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি ৭৮ জন ব্যক্তিকে চারটি দলে ভাগ করেন। এঁদের প্রত্যেকের বয়স ৫৫ বছরের উপরে ছিল এবং অন্তত ১৫ বছর ধরে ইনসমনিয়ায় ভুগছিলেন। প্রথম দলকে নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খেতে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দলকে বলা হয় অহেতুক চিন্তা করা বন্ধ করতে। সেই সঙ্গে নিয়মিত কাউন্সেলরের কাছে যেতে। তৃতীয় দলকে ওষুধের বদলে চিনির বড়ি খেতে দেওয়া হয়। আর চতুর্থ দলকে ঘুমের ওষুধ খেতে দেওয়া হয় এবং সেই সঙ্গে নিয়মিত কাউন্সেলরের কাছে যেতে বলা হয়। দু’বছর পরে চারটি দলকে ফের ডেকে পাঠান মরিন। দেখা যায়, প্রথম আর তৃতীয় দলের প্রথমে রাতে স্বাভাবিক ঘুম এলেও যখনই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, তখনই ফের ইনসমনিয়া ফিরে এসেছে।
অন্য দিকে দ্বিতীয় ও চতুর্থ দলের রোগীদের অবস্থা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়েছে। এমনকী চতুর্থ দলের অনেকে নিজে থেকেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া সত্ত্বেও রাতে স্বাভাবিক ঘুমোচ্ছেন। “অর্থাৎ ওষুধ নয়, চিন্তাহীন অবস্থায় আনন্দে থাকলেই ঘুম আসতে বাধ্য”, বলছেন মরিন।
কলকাতাতেও অনিদ্রা রোগ নিয়ে কাজ যে একেবারে হয়নি তা নয়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মনোবিদ্যা বিভাগ এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট বিভাগ সরকারি হাসপাতালে কর্মরত নার্সদের উপরে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন তাঁদের ৭১ শতাংশের ঘুম নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে। ওই সব নার্স সমীক্ষকদের কাছে জানিয়েছেন, কাজের অত্যাধিক চাপ, রোগীদের চিন্তা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নার্সদের সব সময়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে রাখে। তার উপরে শিফট ডিউটিতে তাঁদের ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’-এর স্বাভাবিক ছন্দও নষ্ট হয়ে যায়। তার ফলেই সংশ্লিষ্ট নার্সরা অনিদ্রার শিকার হন। যে ওয়ার্ডে আশঙ্কাজনক রোগী যতো বেশি, সেই ওয়ার্ডের নার্সদের মানসিক চাপও তত বেশি।
সমীক্ষকেরা দেখেছেন অধিকাংশ নার্সই রাতের ডিউটির চাপ কমাতে বই নিয়ে আসেন। কেউ কেউ সেলাই নিয়ে আসেন। কিন্তু কাজের চাপে বই পড়া কিংবা সেলাইয়ের জন্য সময়ই পান না। অনেকে যোগ ব্যয়ামের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমিয়ে ঘুমের চেষ্টা করেন। নার্সদের দাবি, এই প্রক্রিয়ায় তুলনামূলক ভাল ফল পাওয়া যায়। বিরতির দিন সিনেমা দেখেও অনেকে মনের চাপ কমানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ঘুম না এলে ঘুম হচ্ছে না এই চিন্তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব কি না সেই প্রশ্ন তুলেছেন অধিকাংশ নার্সই। ভারতের কত মানুষ অনিদ্রার শিকার? বিলেতের ওয়ারউইক মেডিক্যাল স্কুলের গবেষকেরা ভারত ও বাংলাদেশের মানুষের উপরে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, প্রতি ২০ জন ভারতীয়ের মধ্যে ১ জন ঘুমের অনিয়ম সংক্রান্ত রোগের শিকার। আরও চিন্তার বিষয় হল, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অনেক বেশি ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত। যার প্রভাব শুধু ওই মহিলাই নন, অন্তঃসত্ত্বা হলে তাঁর সন্তানের উপরেও পড়তে বাধ্য।
কিন্তু ঘুম আনতে চাপমুক্ত হয়ে কাজ করুন, সুস্থ থাকুন এই স্লোগান নানা সমস্যায় জর্জরিত তৃতীয় বিশ্বের মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য সেই প্রশ্ন তুলেছেন এ দেশের মনোরোগ বিশেষজ্ঞেরা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.