রাজ্যে পরিবর্তনের ১৬ মাস পরেও কৃষি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ঋণদানের নিম্নমুখী প্রবণতা অপরিবর্তিতই থেকে গিয়েছে। চলতি আর্থিক বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রথম ত্রৈমাসিকের রিপোর্ট বলছে, কৃষি ক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ ৪৪ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৪২ শতাংশ। যার অর্থ, এ বছরও খরিফ মরসুমে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েই আমন চাষ করতে বাধ্য হয়েছেন বাংলার অধিকাংশ চাষি।
কৃষিঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এই বিরূপ মনোভাবের কারণ কী?
ব্যাঙ্ককর্তাদের একাংশের মতে, চলতি বছরের শুরুতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বিপদে পড়া’ চাষিদের ঋণ শোধ করতে বারণ করেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়তো অভাবী বিক্রির প্রবণতা থেকে ছোট চাষিদের বাঁচাতেই এমন মানবিক অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তার সুযোগ নিয়ে বহু চাষি ব্যাঙ্কঋণ শোধ করেননি। এ বছর কৃষিঋণ মঞ্জুরের ক্ষেত্রে তারই প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন ওই সব ব্যাঙ্ককর্তা।
চাষে ব্যাঙ্কঋণের হারের কমে যাওয়ায় কৃষকেরা যে আরও বেশি মাত্রায় মহাজনদের খপ্পরে পড়বেন, রাজ্যের অর্থ দফতরেরও অনেকে তা মেনে নিচ্ছেন। ওই দফতরের একাধিক কর্তা বলেন, “কৃষিতে ঋণদানের নেতিবাচক প্রবণতা রাজ্যে মহাজনি কারবারকেই আরও শক্তিশালী করবে। যেখানে মাত্র ৪২ শতাংশ কৃষক চাষের খরচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ঋণের মাধ্যমে জোগাড় করতে পারেন, সেখানে ছোট জোতের অধিকাংশ মালিক যে মহাজনদের মুখাপেক্ষী হয়েই এ বারেও চাষের কাজে নেমেছেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।”
তবে শুধু কৃষিতে নয়, সামগ্রিক ভাবে আমানত-ঋণের অনুপাতও এ বছর কমে গিয়েছে। মঙ্গলবার স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কার্স কমিটি (এসএলবিসি)-র বৈঠকে এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। কৃষিঋণ, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর জন্য ঋণদান, কিষান ক্রেডিট কার্ড এবং ‘প্রতি গ্রামে প্রতি হাতে’ ব্যাঙ্ক পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার কাজ যাতে আরও দ্রুত গতিতে এগোয়, ব্যাঙ্কগুলির কাছে সেই আবেদন জানান তিনি। অর্থমন্ত্রী পরে বলেন, “এসএলবিসি-র মধ্যেই কৃষি ক্ষেত্রে ঋণদান নিয়ে আমি একটি সাব-গ্রুপ (উপগোষ্ঠী) করে দিয়েছি। তারা এই ক্ষেত্রটিকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এ দিনের বৈঠকে সমবায় ব্যাঙ্কগুলির মাধ্যমে ঋণদান বাড়াতে আরও একটি সাব-গ্রুপ গড়ার কথাও বলেছি। আশা করছি, বছরের শেষে সামগ্রিক ভাবে ঋণদানের পরিমাণ বাড়বে।”
অমিতবাবু জানান, রাজ্য সরকার কৃষি ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ বাড়াতে চাইছে। এবং তা কিষান ক্রেডিট কার্ড (কেসিসি)-এর মাধ্যমে। ব্যাঙ্কগুলিকে বলে দেওয়া হয়েছে, কোনও বন্ধকী ছাড়াই ৫০ হাজার টাকা মূল্যের কার্ড দিতে হবে সব কৃষককে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিও যাতে একই সুযোগ পায়, সেই আর্জিও জানানো হয়েছে। এসএলবিসি সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত রাজ্যে ৭.২৪ লক্ষ কিষান ক্রেডিট কার্ড বিলি করা হয়েছে। চলতি বছরে দেওয়া হয়েছে প্রায় ৯৪ হাজার কার্ড। রাজ্যে এ-পর্যন্ত ১০ লক্ষ ৩৪ হাজার স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। গোষ্ঠী-পিছু ঋণের পরিমাণ মাত্র ৪৬ হাজার টাকা।
অন্ধ্র ও তামিলনাড়ুতে স্বনির্ভর গোষ্ঠী-পিছু ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। প্রতি গ্রামে প্রতি হাতে ব্যাঙ্ক পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য নয়। দু’হাজারের বেশি জনসংখ্যার ৭১৭০টি গ্রামে এখনও পর্যন্ত ৩৬ লক্ষ ৩২ হাজার অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরা (বিজনেস করেসপন্ডেন্ট) এই অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিদের এই পরিষেবারও গুণগত মান আরও বাড়াতে বলেছেন অর্থমন্ত্রী। |