|
খেলার খবর |
‘নারকেল কাড়াকাড়ি’
(হারিয়ে যাওয়া খেলা। পর্ব ২৭)
অর্ঘ্য ঘোষ • ময়ূরেশ্বর |
|
শৈশবে লুকোচুরি বা ধরাধরি খেলা খেলেননি এমন মানুষ কমই আছেন। কিন্তু ‘নারকেল কাড়াকাড়ি’ খেলা? আজকের প্রজন্মের কাছে এই নাম অজানা হলেও বীরভূম-সহ বাংলার বহু জায়গায় জনপ্রিয় ছিল এই খেলা। এই খেলায় বিজয়ীরা পেত নারকেল। নারকেলের সঙ্গে কখনও কখনও মিলত টাকাও!
পঁচিশ-তিরিশ বছর আগেও নারকেল এখনকার মত সহজলভ্য ছিল না। তখন নারকেল গাছ দেখা যেত পুরনো জমিদার বাড়ি বা এলাকার মুষ্টিমেয় কিছু ধনী ব্যক্তির বাগানেই। ফলে গরিব মানুষের কাছে নারকেল ছিল রীতিমতন ‘মহার্ঘ্য’ একটি বস্তু। সেই নারকেলের প্রতি সাধারণ মানুষের এই আকর্ষণকে হাতিয়ার করেই জমিদার ও ধনী ব্যক্তিরা বিনোদনের জন্য বাংলার গ্রামে গ্রামে এই খেলার প্রচলন করেছিলেন। সাধারণত দুর্গাপূজা, দোল বা জন্মাষ্টমী উপলক্ষে মন্দির চত্বরে এই খেলা অনুষ্ঠিত হত। গ্রামগঞ্জের বহু মানুষ আগ্রহভরে সেই খেলায় যোগ দিতেন। কিন্তু মাঝখানে অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। জমিদারির ভগ্নচিহ্ন নিয়ে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মেরা টিকে থাকলেও নেই সেই কৌলিন্য। আর নারকেলও এখন বাজারে গেলেই পাওয়া যায়। দেখতে দেখতে গ্রামীণ বাংলার ক্রীড়া-সংস্কৃতির একদা জনপ্রিয় এই খেলাও আজ বিলুপ্তির পথে। |
কী ভাবে হতো এই খেলা? প্রথমে এক প্রতিযোগী তাঁর বুকের মাঝে বা বগলের ফাঁকে একটি নারকেল চেপে ধরতো। তারপর বাকি প্রতিযোগীরা ওই প্রতিযোগীর হাতের ফাঁক দিয়ে নারকেল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করত। এই ভাবে একে অপরকে ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে চলত লড়াই। নারকেল যাতে কেউ অল্প সময়ের মধ্যেই কেড়ে নিতে না পারে, তার জন্য নারকেলের গায়ে মাখানো হত তেল-মোবিলের মতো পিচ্ছিল পদার্থ। লড়াইকে আরও জোরালো করার জন্য কখনও কখনও নারকেলের ছোবড়ার ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হত কয়েন। হাত ফসকে মাটিতে নারকেল পড়ার পর, সেটিকে তুলে নেওয়ার জন্য চলত লড়াই। যে প্রতিযোগী নারকেল কুড়িয়ে সেটিকে দু’হাত দিয়ে উপরে তুলে ধরতে পারতো, সেই হতো ওই নারকেলটির মালিক। তবে এই নারকেল জিতে নেওয়ার মাঝের সময়ে লড়াই হতো খুব জোরালো। অতিরিক্ত গরমে লড়াই করতে করতে প্রতিযোগীরা যাতে অসুস্থ না হয়ে যায়, তার জন্য বাইরে থেকে ছুড়ে দেওয়া হতো বালতি বালতি জল।
ময়ূরেশ্বরের বেলিয়ার হোদল মুর্মু, বোলপুরের কোপাইয়ের চেতল হাজরা-রা এক সময় এই অভিনব খেলার আসরে নিয়মিত হাজির থাকতেন। স্মৃতিচারণ করে তাঁরা বলেন, “পয়সা দিয়ে নারকেল কেনার ক্ষমতা ছিল না আমাদের। ওই খেলায় জেতা নারকেল নিয়েই তাই আমরা মজে থাকতাম।” আক্ষেপ করে জানালেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা অবশ্য এই খেলার বিষয়ে একদমই আগ্রহী নয়।
গ্রামের কিছু কিছু অনুষ্ঠানে এই খেলার দেখা পাওয়া গেলেও খেলোয়াড়ের অভাবে একদা জনপ্রিয় এই ‘নারকেল কাড়াকাড়ি খেলা’ যে কিছুদিন পরেই ক্রীড়া-গবেষকদের গবেষণার বিষয় হবে তা বলাই বাহুল্য। |