রতন চক্রবর্তী • শিলিগুড়ি |
কালীঘাট এমএস-৩ (জেমস, তন্ময়, ক্রিস্টোফার)
ইস্টবেঙ্গল-৪ (মননদীপ-২, চিডি-২-পেনাল্টি) |
উত্তেজক নাটককে পঞ্চমাঙ্কে তুলে ফেড কাপের সেমিফাইনালে গেল ইস্টবেঙ্গল। জাতীয় কাপে বাংলা ফুটবলের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং সীমা সুরক্ষা বলয়শিলিগুড়ির পনেরো কিলোমিটার দূরত্বের দু’টো মাঠে মঙ্গলবার বিকেলে নব্বই মিনিট ধরে যা হল তা নিয়ে যে কোনও গল্পকার একটা জমজমাট সিরিয়ালের চিত্রনাট্য লিখতেই পারেন। যার শেষ লাইনগুলো তিনি লিখতে পারেন এই ভাবে সাংবাদিক সম্মেলনে ইস্টবেঙ্গলের বিদেশি কোচ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে বলছেন, “এত সমালোচনা কীসের? কীসের এত প্রশ্ন আমার টিম নিয়ে! ও সব শুনে বা ভেবে আমার কোনও লাভ নেই। বরং দেখুন, ইস্টবেঙ্গল এখন কোথায়? গ্রুপে সবার ওপরে থেকে আমরাই কিন্তু সেমিফাইনালে।”
সীমান্ত জওয়ানদের মাঠে স্পোর্টিং ক্লুব বনাম ওএনজিসি। কাঞ্চনজঙ্ঘায় ইস্টবেঙ্গল বনাম কালীঘাট মিলন সংঘ। শেষ লড়াইয়ে গড়াপেটা আটকাতে একই সময় দুটো ম্যাচ। পয়েন্ট, গোলপার্থক্য, কে ক’টা গোল করল, ক’টাখেলনানা জটিল অঙ্ক ঘুরপাক খাচ্ছে দু’টো মাঠে। প্রতি মুহূর্তে এক মাঠ থেকে অন্য মাঠে ফোন বাজছে, রেজাল্ট কী জানতে চেয়ে। আর সতেরো মিনিটের মধ্যেই কিনা দু’মাঠেই অঘটন। কালীঘাটের কাছে দু’গোল হজম করে ফেলেছে লাল-হলুদ! অন্য মাঠে ওএনজিসি-র কাছে এক গোল খেয়েছে স্পোর্টিং। তা হলে? ইস্টবেঙ্গল আর স্পোর্টিং দু’দলই যদি হারে সেমিফইনালে যাবে কারা? দর্শকদের হাতে-হাতে কাগজ-কলম। নাগাড়ে চলছে হিসেব।
বিরতির আগের মুহূর্তে পেনাল্টি পেল ইস্টবেঙ্গল। চিডিকে নিজেদের বক্সে পা টেনে ফেলে দেন কালীঘাট গোলকিপার শৌভিক মণ্ডল। ম্যাচটা তখনও কালীঘাটের পক্ষে ৩-২ যাচ্ছে। ইস্টবেঙ্গলের মননদীপ টানা দুটো গোল করে ২-২ করার পর ক্রিস্টোফার ফের এগিয়ে দিয়েছিলেন কালীঘাটকে। চিডি পেনাল্টিতে গোল করলেই ফের সমতায় ফিরবে ইস্টবেঙ্গল। নাইজিরিয়ান স্ট্রাইকার পেনাল্টি স্পটে বল বসালেন। গোলও করলেন। হঠাৎই অন্য উত্তেজনা ওই মাঠে গোল শোধ করে দিয়েছে স্পোর্টিং। ডাউসনের পেনাল্টিতে ১-১। আবার অঙ্ক। দু’টো টিমই ড্র করলে শেষ চারে কারা যাবে? |
গোলের পর চিডির ছবি তুলেছেন শঙ্কর নাগ দাস |
এ মাঠে বিরতির পরে আবার পেনাল্টি। চিডিকে নিজেদের বক্সে ফাউল করলেন বাবু মণ্ডল। ফের চিডির গোল। গোলটার পর ইস্টবেঙ্গলের গোটা রিজার্ভ বেঞ্চ লাফিয়ে উঠল। আপাতশান্ত মর্গানও হাত ছুড়ছেন। ম্যাচে প্রথম বার এগিয়ে ইস্টবেঙ্গল। ৪-৩। দমবন্ধ করা পরিবেশটা উধাও কাঞ্চনজঙ্ঘার গ্যালারিতে। ও মাঠেও স্পোর্টিং আবার ১-২ পিছিয়ে পড়েছে। বজবজের ছেলে তারিফ আমেদ গোয়ার দলের জালে দ্বিতীয় বার বল পাঠিয়েছেন। এবং শেষ পর্যন্ত দু’মাঠেই সেই ফলই থেকে গেল। নিট ফল, সাত পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ শীর্ষে থেকে সেমিফাইনালে গেলেন মেহতাবরা। সেমিফাইনালের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে দেখতে মাঠে এসেছিলেন চার্চিল আলেমাও। ম্যাচ শেষে ভিভিআইপি বক্স থেকে চার্চিল কর্তার চিৎকার, “রেফারি জিতিয়ে দিল ইস্টবেঙ্গলকে। দু’টো পেনাল্টিই হয় না। গটআপ। গটআপ। এ রকম রেফারিং হলে আমরা সেমিফাইনাল খেলব কি না ভাবতে হবে।” বুঝতে হয়তো অসুবিধে নেই যে, বৃহস্পতিবার জেমস মর্গ্যান বনাম সুভাষ ভৌমিকের ধুন্ধুমার যুদ্ধের আগে চাপ তৈরির সুচতুর কৌশল চার্চিলের। আলেমাও পোড়খাওয়া রাজনীতিক । জানেন কখন কোনটা করতে হয়।
কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের পোড়খাওয়া ব্রিটিশ কোচ কী ভাবে ওপারা-গুরবিন্দরকে স্টপারে না নামানোর আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিলেন এ রকম গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের শুরুতে? বিশেষ করে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বড় চেহারার দুই বিদেশি ক্রিস্টোফার আর জেমস গোলটা ভাল চেনেন। লাল-হলুদ শিবির থেকে জানা যাচ্ছে, দু’জনেরই একটা করে হলুদ কার্ড আছে বলে সেমিফাইনালের কথা ভেবে তাঁদের রিজার্ভে রেখেছিলেন কোচ। কিন্তু কোচেরা ভাবেন এক, হয় আর এক। মরসুমে প্রথম বার একসঙ্গে নামা দুই ভারতীয় অর্ণব মণ্ডল আর রাজু গায়কোয়াড় সামলাতেই পারলেন না বিশাল চেহারার নাইজিরিয়ানদের! মর্গ্যান ম্যাচের পর স্বীকার করলেন, দ্বিতীয়ার্ধে ওপারাদের না নামালে আজ জেতা কঠিন ছিল। “নিজের ভুলটা আমিই দ্বিতীয়ার্ধে শুধরে নিয়েছি। ওপারা-গুরবিন্দর নামার পর আমরা কিন্তু গোল খাইনি,” হাফ ছেড়ে বাঁচার ভঙ্গিতে বললেন মর্গ্যান।
কিন্তু মর্গ্যানের দলকে তো জেতাল দু’টো পেনাল্টি আর কালীঘাটের ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা স্ট্রাইকার জেমসের চোট পেয়ে দ্বিতীয়ার্ধে মাঠের বাইরে চলে যাওয়াটা। লিখতে দ্বিধা নেই, যে দু’টো পেনাল্টি চিডিরা পেয়েছেন তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকতে পারে না। বরং ইস্টবেঙ্গল আরও একটা পেনাল্টি পেতে পারত। কালীঘাট কোচ অরুণ ঘোষও বললেন, “অনেকেই ভেবেছিলেন আমরা ম্যাচটা ছেড়ে দেব। কিন্তু আমরা কী লড়াইটা করলাম সবাই দেখেছে। একটুর জন্য আমরা হারলেও আমি খুশি যে, বাংলার একটা দল সেমিফাইনালে উঠেছে। চারটেই গোয়ার টিম উঠলে খারাপ হত।”
কে কী বলছে তা নিয়ে অবশ্য মর্গ্যানের মাথাব্যথা নেই। তিনি অঙ্ক কষতে শুরু করে দিয়েছেন চার্চিল ব্রাদার্সকে নিয়ে। লাল-হলুদ কোচ বুঝে গিয়েছেন, গ্রুপের তিন প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে সুভাষ-ব্রিগেড অনেক শক্তিশালী। রীতিমতো কঠিন ঠাঁই!
|
হঠাৎ গড়াপেটার ধোঁয়া কেন?
১) কালীঘাট এম এস-এর প্রেসিডেন্ট ইস্টবেঙ্গলের কার্যকরী কমিটির সদস্য। এই তথ্য গোয়ার ক্লাব জেনে যাওয়ার পর গড়াপেটা বিতর্কের সূত্রপাত।
২) দু’টি ক্লাবই কলকাতার হওয়ায় জল্পনা আরও বাড়ে। বিশেষ করে যেখানে কালীঘাট এম এস-এর এই ম্যাচ থেকে কিছু পাওয়ার ছিল না।
ময়দান যা বলছে... |
মিসাইল
মোহন-সচিব অঞ্জন মিত্র: গড়াপেটা হয়েছে বলে খবর পাচ্ছি। ফেডারেশনের কাছে তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।
মহমেডান কর্তা কামারউদ্দিন: তদন্তের দাবি আমিও তুলছি। এ ভাবে চললে ভারতীয় ফুটবলেরই ক্ষতি। |
পাল্টা মিসাইল
ইস্টবেঙ্গল-কর্তা দেবব্রত সরকার: তদন্ত হোক। আমরা জানি ম্যাচ গড়াপেটা হয়নি। এখন যাঁরা তদন্তের দাবি তুলছেন, ভুল প্রমাণিত হলে তাঁদের যেন শাস্তি দেয় ফেডারেশন। |
বল যাদের কোর্টে
ফেডারেশন সচিব কুশল দাস: গড়াপেটার কোনও সম্ভাবনাই নেই। কারণ দুটো ম্যাচ একই সময় শুরু হয়েছিল। আর ইস্টবেঙ্গল তিন গোল খেয়েছে, ম্যাচটা হারতেও পারত। |
|
ইস্টবেঙ্গল: গুরপ্রীত, নওবা, অর্ণব (ওপারা), রাজু (গুরবিন্দর), সৌমিক, সঞ্জু, মেহতাব, পেন, লালরামডিকা, মননদীপ, চিডি। |