প্রবন্ধ ২...
দিদি বাম হয়েছেন, সি পি আই এম এখন কোথায় যায়? কী করে?
নিন্দুকেরা বলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের কথার জালে বন্দি। যেটা শেষে বলার, সেটা শুরুতে বলে বসেন, ফলে শুরুতেই শেষের ঘণ্টা বেজে যায়! তাদের বক্তব্য, যেহেতু ডিজেল, রান্নার গ্যাস আর রিটেল নিয়ে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত ঘোষণা হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যে তৃণমূল সুপ্রিমো সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য ৭২ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন, এবং যেহেতু এই সময়সীমার মধ্যে জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব পিছু হটার কোনও ইঙ্গিত দেননি, এমনকী এমন সম্ভাবনার কথা জানিয়ে একটা ফোন পর্যন্ত করেননি, তাই মমতার এমন চরম সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
এই মুহূর্তে মমতার নিন্দুকদের দু’টি বড় অংশ: জাতীয় কংগ্রেসের রাজ্য নেতৃত্ব ও মমতার চিরশত্রু সি পি এম তথা বামফ্রন্ট। মমতাকে বিঁধতে প্রদেশ কংগ্রেসের কিছু নেতা নানা চ্যানেলে যা বলেছেন, তাতে মমতার কতটা এল-গেল বোঝা না গেলেও সি পি এম যথেষ্ট অস্বস্তিতে পড়েছে। কংগ্রেসের নেতারা বলছেন, মমতা সি পি এমের চেয়েও বেশি সি পি এম হয়ে উঠেছেন! এমন কথা সি পি এমের মেনে নেওয়া আত্মহত্যার শামিল। কোনও অ-বাম দল যদি সরকারি-বামেদের চেয়ে বেশি বাম হয়ে পড়ে, তবে মৌলিক রাজনীতি নিয়েই টানাটানি নিজের একচেটিয়া ক্ষেত্রে কেই-বা অন্যকে জায়গা করে দিতে চায়!
সরকারি বামপন্থীদের, বিশেষত সিপিএম’কে অবশ্য নানা রঙের নকশালপন্থী-সহ অনেক বামপন্থীই ‘মেকি বামপন্থী’ বলে, সিপিএমের তাতে খুব একটা এসে যায় না, তারাও নকশালদের ‘হঠকারী’ বলে। তার চেয়ে বড় কথা, তারা তো (বা এসইউসি) কখনও রাজ্য চালানোয় সিপিএমের প্রতিস্পর্ধী হবে না। কিন্তু এ রাজ্যে সিপিএমের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলটি যাকে এতদিন বামেরা দক্ষিণপন্থী নৈরাজ্যবাদী ‘লুম্পেনদের’ দল বলে এসেছে, আজ অনেকে যদি তাদের ‘বামপন্থী’ ভাবতে শুরু করে, তবে তো ‘পার্টির’ অস্তিত্বেরই সংকট। এই কারণেই, এমন তুলনায় বিব্রত দলের প্রবক্তারা বলছেন, মমতা/তৃণমূল কেন্দ্রের নানা উদারীকরণের নীতির বিরুদ্ধে যে ভাষা/শব্দচয়ন করছেন, তা শুনতে বামপন্থীদের মতো হলেও, আসলে তা নিছকই অন্তঃসারশূন্য ভাষার অলংকার (রেটোরিক) মাত্র, যা খালি চেহারায়, বহিরঙ্গে বামপন্থী অন্তরঙ্গে নয়।
পথে এ বার। অর্থ সংগ্রহে সি পি আই এম নেতারা। পি টি আই
আমজনতা অবশ্য বহিরঙ্গ দেখেই ‘বামপন্থী’ চেনে এবং তা-ই কেনে। নইলে মুলায়ম সিংহ যাদবের দলের নাম ‘সমাজবাদী’ হয় কী করে, বা রামমনোহর লোহিয়ার চিন্তাভাবনার সঙ্গে ক্ষীণতম যোগ না রেখেও লালুপ্রসাদ কথায় কথায় ভারতের অন্যতম অ-কমিউনিস্ট সমাজবাদী লোহিয়ার উল্লেখ করেন কী করে? করেন, কেননা, এ দেশের সাধারণ মানুষ বামপন্থা/সমাজবাদ বলতে নেহরু-মহলানবিশের পরিকল্পিত অর্থনীতির মডেল বোঝে, সরকারি তত্ত্বাবধানে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান-জীবিকার সংকুলানের কথা বোঝে, বা গাঁধী/বিনোবা/জয়প্রকাশ/লোহিয়া মিশিয়ে গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণ ও নিম্নবর্ণের উত্থানের কথাও বোঝে। ১৮৬২ সালের ২৮ ডিসেম্বর স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক সহকর্মী ডা. কুগেলমানকে লেখা চিঠিতে কার্ল মার্কস কী গূঢ় তত্ত্ব আলোচনা করেছিলেন, তা (আধা) জেনে সমাজবাদ/বামপন্থা বোঝে না! আমজনতার বামপন্থার একটা ছক আছে, যেটা ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকেই চালু রয়েছে (প্রসঙ্গত, বিপ্লবোত্তর ফরাসি আইনসভা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ‘বাঁ দিকে’ যে-সব চরমপন্থী/পরিবর্তনমুখী সদস্য বসতেন, তাঁরাই পরে ‘বামপন্থী’ বলে খ্যাত হয়েছিলেন), যার সঙ্গে পরে যুক্ত হয়েছে উনিশ ও বিশ শতকের নানা সংস্কারপন্থী, র্যাডিকাল ও বিপ্লবী ঐতিহ্য। এর অনেকগুলি একে অন্যের পরিপূরক, আবার কতকগুলির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। তবু কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য বলতে গৌড়জনে বোঝে: প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা, ধনী-দরিদ্রের সম্পদগত ফারাক কমিয়ে আনা, গরিবের জন্য বিশেষ সুবিধা-সুযোগ ও অধিকার, আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন ইত্যাদি।
বামপন্থার এই সব সাধারণ বৈশিষ্ট্য মিশে আছে বাংলার ধূলিকণায়। উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রান্তে অবস্থিত বলে চিরদিনই বাঙালিরা বেয়াড়া গোছের একমাত্রিক কোনও কিছুতেই, এমনকী ধর্মবিশ্বাসেও প্রবল অবিশ্বাস। ‘ভগবান রামচন্দ্রের’ চেয়ে ভাদু-টুসু তার কাছে কম আদরের নয়। চৈতন্যদেব থেকে বিবেকানন্দ চিন্তায় ও কাজে, তাঁদের ভিন-প্রদেশি সমসাময়িক ধর্মগুরুদের চেয়ে অনেক র্যাডিকাল। রাজনীতিতেও চিত্তরঞ্জন দাশ বা সুভাষচন্দ্র চিরকাল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরোধিতা করে গেছেন। সুভাষচন্দ্র তো তাঁর নিজস্ব ব্র্যান্ডের বামপন্থা তৈরি করেছিলেন এক ধরনের অ্যাকশনধর্মী জনপ্রিয় আন্দোলন চালিয়ে (যেমন, হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙার কর্মসূচি গ্রহণ করে)। তাঁর বামপন্থী আদর্শ যাকে তিনি ‘সাম্যবাদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন তা আগমার্কা মার্কসবাদ নয়, গড়ে উঠেছিল হেগেলীয় ‘সিন্থেসিসের’ বা সংমিশ্রণের ধারণার ওপর, ফ্যাসিবাদ ও কমিউনিজমের মূল বৈশিষ্ট্যগুলির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে। বামপন্থার এই ট্র্যাডিশনের সঙ্গেই ১৯৪০-এর দশকের শেষ থেকে মিশেছিল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন। এর পর বঙ্গে বামপন্থার মূল দাবিদার তারাই। দেশভাগের পর উদ্বাস্তু আন্দোলন, ট্রামের ভাড়াবৃদ্ধি-বিরোধী আন্দোলন ও খাদ্য আন্দোলন, যার পথ বেয়েই ১৯৬৭ ও ’৬৯ সালে দু’বার যুক্তফ্রন্ট সরকারের আসা-যাওয়া পরে আরও র্যাডিকাল নকশালপন্থী আন্দোলন ব্যক্তিহত্যার কানাগলিতে ঢুকে পড়লে, যে বামপন্থা প্রায় এক দশক হোঁচট খেয়ে ফের ফিরে আসে বামফ্রন্টের রূপে। প্রথম কয়েক বছর ভূমি সংস্কার, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করে, কেন্দ্র-বিরোধী যুক্তরাষ্ট্রীয় মঞ্চ গড়ে, কী ভাবে নিজেই সর্বগ্রাসী প্রতিষ্ঠান হয়ে গেল, সে অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।
কিন্তু বামফ্রন্টের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার একমাত্র লক্ষ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আত্মীকরণ করলেন, তা (‘বহিরঙ্গের’ হলেও) এই বাংলার সামগ্রিক বাম-সংস্কৃতি। কোনও তত্ত্ব পড়ে এই দর্শন তিনি বেছে নেননি, তাঁর জীবনের অনেক কিছুর মতোই এটাও এসেছে চলার পথে। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের আন্দোলন তাঁর অগোছালো বাম-সংস্কৃতিকে অনেকটা নতুন দিশা দিয়েছে, ফলে ভূমি অধিগ্রহণ বা ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’-বিরোধী ভারতে যে-কোনও আন্দোলনে তিনি এখন ‘রেফারেন্স পয়েন্ট’। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর, বামপন্থী পূর্বসূরিদের মতোই তিনি আবিষ্কার করেছেন রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনার কথা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর গুরুত্ব। অনেকটা জ্যোতি বসুর ধরনে অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের জোটও গড়তে চাইছেন।
আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচন ও বছরখানেকের মধ্যে সম্ভাব্য লোকসভা নির্বাচনে এই বামপন্থার তরণী বেয়েই কেল্লা ফতে করতে চাইছেন মমতা। উদারপন্থী নিরাবেগ অর্থনীতি নয়, বামপন্থী লোকমুখী আবেগকে মূলধন করেই তাঁর যাত্রাপথ নির্ণয় করছেন। এতে দেশ তথা রাজ্যের ‘গ্রোথ রেট’ কমল না বাড়ল, অর্থশাস্ত্রীরা সে হিসেব কষুন। তবে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ‘বিজেপি-র প্রার্থী’কে সমর্থনের বদলে কংগ্রেসের প্রার্থীকে করে, জে এন ইউ’তে জহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিরাচরিত সমর্থন-ভিত্তি ধসে গেলে ফের ডিজেল-গ্যাস-এফডিআই প্রসঙ্গে ভারত বন্ধের দিন বিজেপি-রই পাশে দাঁড়ানো দিশেহারা সি পি এমের বামপন্থী সুপবন যে মন্ত্রিত্ব বলিদান দিয়ে ও সমর্থন প্রত্যাহার করে মমতা তাঁর পক্ষে ঘুরিয়ে এনেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। এর অন্যথা হলে পঞ্চায়েত ভোটে বামপন্থীরা যে তাঁকে ‘ছিঁড়ে খেতেন’ এ কথা মমতা এবং সিপিএম ছাড়া আর ভাল কে জানে! এখন হয়তো অতীত রোমন্থন করে অনেক বামপন্থী ভাবেন, চার বছর আগে পরমাণু চুক্তির মতো ‘খায় না মাথায় দেয়’ ইস্যুতে সমর্থন না তুলেও, তখনও যদি মূল্যবৃদ্ধিকে সামনে রেখেই সমর্থন প্রত্যাহার করা হত...

শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.