|
|
|
|
প্রবন্ধ ১...
যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি |
|
বন্ধু বলছিলেন, ভারত
নাকি অহিংসার দেশ! |
|
“আমি লজ্জায় অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ছিলাম। এত বড় প্রশংসা ভারতের প্রাপ্য নয়,
ইতিহাসসম্মতও নয়।” গাঁধীজিও খুন হয়েছিলেন এ দেশের মানুষেরই হাতে। লিখছেন
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব! তিনি জেনে গেলেন কি না জানি না, স্বাধীনতা এসে গিয়েছিল তার পাঁচ সাত বছর পরেই। কিন্তু রক্তের স্রোত থামেনি, বেড়েই চলেছে।
আমার জন্ম পরাধীন ভারতে। দেশভাগ আর স্বাধীনতা যখন আসে, তখন আমার কৈশোর, সেই সময়কার অনেক স্মৃতিই এখনও মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করে। সেই বয়েসে মানুষের বিশ্বাস ও আদর্শে কোনও ভেজাল থাকে না। সত্যি আর মিথ্যার মধ্যে থাকে একটা স্পষ্ট বিভাজিকা।
সেই চল্লিশের দশকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখেছি আমরা। তাতে কত লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল তার সঠিক হিসেব আজও হয়নি। হিটলারের ইহুদি নিধনের কাছাকাছিই হবে। তার পর ছেচল্লিশের সাঙ্ঘাতিক দাঙ্গা, এবং স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশভাগের নির্মম ট্র্যাজেডি। আমাদের পরিবারও সেই ট্র্যাজেডির মধ্যে পড়েছিল। এত সব কাণ্ডের মধ্যেও আমরা কী করে যে বেঁচে রইলাম, সেটা আজও বিস্ময়কর মনে হয়। এর সব কিছুরই জন্য দায়ী আমাদের শাসক বিদেশি সরকার। যারা এ দেশের ভালমন্দ কিছু গ্রাহ্যই করে না। তারা যত দূর সম্ভব ভারতীয় সম্পদ লুটেপুটে নিয়ে যেতে চায়। সুতরাং ওরা চলে গেলেই কিংবা যেতে বাধ্য হলেই স্বাধীন ভাবে সোনার ভারত গড়ার কার্যক্রম শুরু হবে। আমরা সত্যিই বিশ্বাস করেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সেই দৃপ্ত ঘোষণায়, দেশ স্বাধীন হলেই তিনি কালোবাজারিদের ধরে ধরে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবেন। এটা অতিশয়োক্তি হতে পারে, কিন্তু কিছু তো করবেন তিনি। কিন্তু কিছুই করেননি, বা
করতে পারেননি। বরং তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি হচ্ছিল হু হু করে। এখনকার খোলা বাজারের মতোই সে যুগে কালোবাজার দেশকে গ্রাস করে নিচ্ছিল।
যাই হোক, এ সব নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, এখনও হয়। আমি আর তা চর্বিতচর্বণ করতে চাই না। তবে সেই সব স্মৃতি হঠাৎ আমার মনে গজগজ করছে। তাই না-লিখে পারছি না। আমি লেখালেখির জগতে প্রবেশ করার পর পোল্যান্ডের এক লেখিকার সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তিনি বেশ খ্যাতিময়ী। নোবেল পুরস্কারের জন্যও কয়েক বার তাঁর নাম উঠেছিল। তিনি একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, পৃথিবীর মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করেন ভারতকে। কারণ, কখনও ভারত অন্য কোনও দেশ আক্রমণ করেনি। সাম্রাজ্য বিস্তারেরও কোনও চেষ্টা করেনি। ভারত হচ্ছে অহিংসা ও শান্তির দেশ।
এ কথা শুনে কি গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠা উচিত ছিল? না, আমার তা হয়নি, আমি বরং লজ্জায় অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ছিলাম। এত বড় প্রশংসা ভারতের প্রাপ্য নয়, ইতিহাসসম্মতও নয়। ভারত অন্য কোনও দেশ আক্রমণ করেনি, তার মূল কারণ, ভারতের সে রকম ক্ষমতাই ছিল না। এত বড় দেশে কোনও বিশাল ও মজবুত সেনাবাহিনী গড়ে ওঠেনি। এমনকী মোগল আমলেও না। |
|
অবিরত বর্বরতা। কামরূপ, অসম। অগস্ট ২০১২। |
আর অহিংসা আর শান্তির দেশ? অহিংসা শব্দটি তখন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল মহাত্মা গাঁধীকে কেন্দ্র করে। তাঁর অহিংসা সত্যাগ্রহ আন্দোলন সারা পৃথিবীতেই অভিনব। কিন্তু আমরা জানি, এ দেশের মানুষ মোটেও অহিংস নয়। গাঁধীজি পরাধীন আমলে খুন হননি, খুন হয়েছেন স্বাধীন ভারতে। ভারতীয়রা আত্মকলহ কিংবা নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেই বেশি দক্ষ। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ‘শক-হুণ দল পাঠান-মোগল’ যখন তখন এসেছে আর ভারতীয়রা মারও খেয়েছে। তাও তো চেঙ্গিস খান এ দেশে ঢোকেননি। ঢুকলে আরও কত লক্ষ মানুষ তাদের মুণ্ডু হারাত, কে জানে!
ছেলেবেলায় পাঁঠাবলি দেখেছি। তখন শুনতাম, এক বলিতেই পাঁঠার গলা কাটতে হবে। কেউ যদি তা না-পারে, তা হলে দুর্গা বা কালীমাতা অত্যন্ত রেগে যাবেন। অভিশাপও দিয়ে ফেলতে পারেন। সেই জন্য সে অঞ্চলের কোনও বলশালী লোককে ডেকে আনা হত। পালোয়ান সেজেগুজে এসে দাঁড়াত। পাঁঠাটাকে রাখা হত হাঁড়িকাঠে। দু’তিন জন লোক উল্টো দিক থেকে পাঁঠার মাথা টেনে ধরত, যাতে তার গলাটা যত দূর সম্ভব লম্বা করা যায়। পাঁঠাটা মৃত্যুভয়ে চেঁচাত আর আততায়ীরাও ভক্তিভরে ডাকত মা মা...তার পরেই ঘচাং। কখনও সে কোপ ব্যর্থ হতে দেখিনি।
আমাদের ধারণা ছিল, মানুষের গলা কাটা অত সহজ নয়। ভুল ধারণা। এখন তো দেখছি প্রায়ই এখানে সেখানে মুণ্ডহীন ধড় পাওয়া যাচ্ছে। এ রকম বর্বরতা অন্য কোনও সভ্য দেশে নেই। ছেলেবেলায় শুনতাম, কোনও কোনও অঞ্চলে এক জন অসহায় নারীর উপর ডাইনিগিরির অভিযোগ চাপিয়ে পুড়িয়ে মারা হত। আজও তেমন ঘটনা শুনতে পাই। পঞ্চাশ ষাট বছর আগে বড় বড় রাস্তার মোড়ে স্ত্রীলোককে দেখেছি একটা শিশুকে কোলে নিয়ে ভিক্ষে চায়। এখনও তা দেখি। হঠাৎ আমার মনে হয় যেন এত বছর ধরে সেই একই স্ত্রীলোক একই শিশু নিয়ে ফিরে ফিরে আসে।
এক সময় শোনা যেত যে, ভারতের তিনটি বড় বড় শহরের মধ্যে এক একটাতে এক এক পরিচয় দেগে দেওয়া হয়েছে। যেমন, দিল্লি তো অবশ্যই রাজনৈতিক রাজধানী। বম্বে অর্থাৎ অধুনা মুম্বই হচ্ছে ব্যবসাবাণিজ্যের রাজধানী আর কলকাতা হচ্ছে শিল্প-সাহিত্যের রাজধানী। কে রটিয়েছে তা জানি না। হয়তো বাঙালিরাই। বাঙালিরা ব্যবসা বাণিজ্য করতে জানে না, রাজনীতিতেও তেমন উঁচু জায়গায় পৌঁছতে পারে না। তাই তাদের দেওয়া হয়েছে শিল্প সংস্কৃতির তকমা। যদিও এটা অর্থহীন। বাঙালিদের মধ্যে বহু স্রষ্টার অভূতপূর্ব উত্থান হয়েছে, যেমন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, যামিনী রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। কিন্তু তাদের প্রভাব কতখানি? একটা ছোট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। অধিকাংশ বাঙালি মূর্খ, তাদের শিল্প-সাহিত্যের কোনও বোধই নেই। অর্ধেকের বেশি বাঙালি তো এখনও পড়তে-লিখতেই জানে না।
লেখাটা থামিয়ে হঠাৎ আমার মনে হল, এ সব আমি লিখছি কেন? আমি তো সাধারণত নৈরাজ্যের কথা লিখতে চাই না। আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও আমার হাতে ঠিক আসে না। এ লেখা কি শেষ হবে তিক্ততার স্বাদ নিয়ে?
তা হলে একটা অন্য কথা বলি। বারো পনেরো বছর আগেকার কথা। এক সন্ধেবেলা আমি এক কবিবন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম, সে দিনটা যে তাঁর জন্মদিন তা না-জেনে। বাইরের বসার ঘরে অনেক ফুলের তোড়া আর কিছু কিছু নারী পুরুষ রয়েছে। কবি সেখানে নেই। তিনি উঠে গেছেন একটু আগে একটা ভেতরের ঘরে। এ বাড়িতে আমার অবাধ ঘোরাফেরার অধিকার আছে, তাই চলে গেলাম সেই ভেতরের ঘরে। নতুন ধুতি পাঞ্জাবি আর কপালে চন্দনের ফোঁটা নিয়ে মাটিতে আধশোয়া হয়ে রয়েছেন সেই কবি। আরও আট জশ জন তরুণ দু’জন তরুণী সমেত সেখানে বসে আছে, কেউ চেয়ারে, কেউ মাটিতে।
বন্ধুটি আমাকে বসতে বলল। ওদের একজন একটা কবিতা পড়তে শুরু করল। তখন ওদের দিকে তাকিয়ে কয়েক জনকে চিনতে পারলাম। জয় গোস্বামী, পিনাকী ঠাকুর, শ্রীজাত, বিনায়ক, শিবাশিস, শ্যামলকান্তি, রূপক, চিরঞ্জীব, জয়দেব, সেবন্তী আর প্রায় তরুণী নবনীতা। আরও কেউ কেউ হয়তো ছিল। এরা সবাই নতুন কবিতা এনেছে এখানে পাঠ করার জন্য। বর্ষীয়ান কবিকে শোনাবার জন্য নয়। নিজেরাই নিজেদের কবিতা শোনাবে। এমনকী সেই কবিও একটু লাজুক মুখে বললেন, আমিও দুটো কবিতা নতুন লিখেছি। যদি তোমরা আমায় একটা চান্স দাও।
প্রথমটায় সেই কবিতা পাঠে আমি মনোযোগ দিতে পারিনি। মনটা খুবই চঞ্চল হয়ে ছিল। সে দিন সকাল থেকে নানা কুৎসিত ও বীভৎস ঘটনা শুনতে হয়েছে। শুনেছি, একটা ছোটদের স্কুলে কিছু অস্ত্রধারী (তারা ডাকাত না বিপ্লবী তা অবশ্য জানা যায়নি) ছাত্রদের সামনেই শিক্ষককে গুলি করে হত্যা করেছে। এখানে এই কবিতার আসরে সে সব ঘটনার চিহ্নমাত্র নেই। তাদের কবিতা যেমন নানা বিষয়ে, তেমনই তাদের পাঠেও গুরুগম্ভীর জ্যাঠামি নেই। আমার মনে এই প্রশ্ন এসে গেল, কবিতা কি মুছে দিতে পারে সমাজের এত গ্লানি? ক্রমে সব প্রশ্নটশ্ন ভুলে গিয়ে আমিও ডুবে গেলাম কবিতার রসে।
সেই দিনটি আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। তার পর থেকেই যখন কোনও সাংঘাতিক ঘৃণ্য ব্যাপার ঘটতে থাকে, যার প্রতিকার করার ক্ষমতা আমার নেই, শুধু শুধু মর্মযাতনা ভোগ করতে হয়, তখন আমি কোনও প্রিয় কবির কবিতার বই খুলে পড়তে শুরু করি। প্রথমে কয়েক মিনিট মন বসাতে পারি না, তার পর আস্তে আস্তে নিমজ্জিত হই কবিতার রসে। হ্যাঁ, কবিতার সেই শক্তি আছে। বাস্তবের নগ্ন দিকটা সে ভুলিয়ে দিতে পারে। |
|
|
|
|
|