সাক্ষরতার প্রসারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার হইতে বিশেষ অনুদান পাইবে পশ্চিমবঙ্গ। সুসংবাদ? না, দুঃসংবাদ। যদিও রাজ্যে অর্থের অভাব অতি প্রকট, তবু এই একটি বিষয়ে সম্ভবত ব্যর্থতার কটু স্বাদ অর্থাগমের আশ্বাসকেও ছাড়াইয়া যাইবে। কারণ, এই অনুদান মিলিতেছে সেই সব রাজ্যেরই, যাহারা নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যথেষ্ট সফল নয়। এই অনুদান গৌরবের নয়, লজ্জার।পশ্চিমবঙ্গ সাক্ষরতার আন্দোলনে এক সময়ে গোটা দেশকে পথ দেখাইয়াছিল। কেরলে যে আন্দোলনের শুরু, উত্তর ভারতে পশ্চিমবঙ্গই তাহাকে আগ্রহের সহিত গ্রহণ করিয়াছিল। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় রাজনৈতিক ইচ্ছা এবং প্রশাসনিক তৎপরতা, এই দুইয়ের সমন্বয়ে সাক্ষরতা মিশনে কিছু গতি আসিয়াছিল। কিন্তু এক দিকে কাজের তুলনায় ঢক্কানিনাদ অধিক করিবার রাজনৈতিক প্রবণতা, অপর দিকে দরিদ্র নারীপুরুষকে সাক্ষরতার আলোক দেখাইবার পর সেই শিখাটি জ্বালাইয়া রাখিবার উপযুক্ত প্রকল্পের অভাব, এই দুই মিলিয়া প্রাথমিক লাভের প্রায় সবটিই নষ্ট হইয়া গিয়াছে। সাক্ষরতার প্রকল্প হইতে রাজনৈতিক সুবিধা লুটিতে যদি নেতারা এত ব্যস্ত হইয়া না উঠিতেন, একের পর এক জেলাকে ‘পূর্ণ সাক্ষর’ ঘোষণা করিয়া বাহবা লুটিবার ইচ্ছা সংবৃত করিতে পারিতেন, তাহা হইলে হয়তো রাজ্যবাসীর কিছু লাভ হইত।
কিন্তু যাহা হইয়া গিয়াছে বলিয়া প্রমাণিত, তাহা আবার নূতন করিয়া করিবার প্রয়োজন কী? কেনই বা তাহাতে আবারও বিনিয়োগ? তাহাতে নূতন চমক কিছুই থাকিবে না। তাই বহু মানুষের উদ্যোগে, বহু সম্পদ ব্যয়ে যে মহৎ কাজের সূচনা হইয়াছিল, তাহার ফসল ঘরে তুলিবার আগেই সব নষ্ট হইয়া গেল। শূন্য হাতে তাই পশ্চিমবঙ্গকে আবার গোড়ায় গিয়া শুরু করিতে হইবে। রাজ্যবাসীর নিকট ইহার চাইতে আফশোসের আর কিছুই নাই। ২০১১ সালের জনগণনাতে যে ২৩ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর বলিয়া দেখা গিয়াছে, তাঁরা অনেকেই হয়তো পূর্বে সাক্ষর ছিলেন, অনভ্যাসে আবার ফিরিয়া গিয়াছেন নিরক্ষরতায়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের একটি বড় অংশ এখনও টিপসই দিতে এবং নিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। কিন্তু পূর্বের ভ্রান্তির জন্য আক্ষেপ করিয়া কালাতিপাত করিলেই চলিবে না, সমস্যার সমাধান করিতে হইবে। বর্তমানে এ রাজ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতার কোনও কার্যক্রম নাই বলিলেই চলে। ‘সর্বশিক্ষা মিশন’ নামে সকলের শিক্ষার কথা বলিলেও, কাজে বুনিয়াদি শিক্ষার প্রকল্প হইয়াই রহিয়া গিয়াছে। অথচ জেলাগুলিতে দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলে ৩০-৪০ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর রহিয়া গিয়াছেন। ইহাদের অনেকেই তরুণ, যুবক। ইহাদের বাদ রাখিয়া সাক্ষরতার লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নহে, সুতরাং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সাক্ষরতার প্রকল্পকে ফিরাইয়া আনিতেই হইবে। ইহার কোনও বিকল্প নাই।
অপর একটি সমস্যা স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। এই রাজ্যে এক বিপুল পরিমাণ ছাত্র-ছাত্রী স্কুলের শিক্ষা সম্পূর্ণ করে না। ইহাদের অনেকেই কোনও ক্রমে প্রাথমিকের গণ্ডি ছাড়াইয়া স্কুল হইতে বিদায় নয়। বহু ক্ষেত্রেই যে হেতু প্রাথমিকে তাহারা অতি অল্পই শেখে, অনেকেই লিখিতে-পড়িতেও ঠিক মতো শেখে না, তাই কিছু দিন অনভ্যাসের পর তাহারা কার্যত নিরক্ষরেই পরিণত হয়। মানবসম্পদের এই বিশাল অপচয় রুখিতে স্কুলছুট সমস্যা বন্ধ করিতে হইবে। বিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের নিয়মিত উপস্থিতি বাড়াইতে হইবে। আরও অনেক কর্তব্য থাকিতে পারে, কিন্তু মূলত এই দুইটি পন্থা না লইলে সাক্ষরতার প্রশ্নে রাজ্যকে বার বার অপদস্থ হইতে হইবে। পরিসংখ্যানের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না। |