বিপর্যয় অসমের পিছু ছাড়িতেছে না। নমনি অসমে সাম্প্রদায়িক দুর্যোগ এখনও ঘোচে নাই, ইতিমধ্যে ব্রহ্মপুত্র ও তাহার উপনদীগুলির জলোচ্ছ্বাসে রাজ্যের ১৪টি জেলা প্লাবিত, দশ লক্ষেরও বেশি মানুষ বানভাসি। বন্যার জল রাজধানী গুয়াহাটি শহরের বিস্তীর্ণ এলাকাও প্লাবিত করিয়াছে, যাহার জেরে অন্তত ছয় শত জলবন্দি পরিবারকে উদ্ধার করিয়া নিরাপদ স্থানে সরাইয়া লইতে হইয়াছে। পরিস্থিতি যখন এমন, তখন দুর্গতদের পাশে দাঁড়াইয়া তাঁহাদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে হাত লাগানো হইবে, ইহাই প্রত্যাশিত। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন অসরকারি, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেই কাজে ঝাঁপাইয়াও পড়িয়াছে। অথচ ইহারই মধ্যে জঙ্গি সংগঠন আল্ফা-র আলোচনা-বিরোধী গোষ্ঠী একের পর এক দূরনিয়ন্ত্রিত বোমা বিস্ফোরণ করিয়া নিরীহ মানুষদের হত্যা করিতেছে। সোমবারেও শিবসাগর জেলার একটি সিনেমা হলের সামনে সাইকেলে বাঁধিয়া রাখা এমন বোমা এক শ্রমজীবীর প্রাণ লইয়াছে। আল্ফার জঙ্গি গোষ্ঠী বলিয়াছে, এই বিস্ফোরণের দায়িত্ব তাহাদের।
এই গোষ্ঠীর স্বঘোষিত কমান্ডার-ইন-চিফ পরেশ বড়ুয়া প্রথমাবধি অরবিন্দ রাজখোয়াদের আপস-আলোচনার পরিপন্থী। অসমকে তিনি ভারতের ‘উপনিবেশ’ বলিয়া গণ্য করেন, যাহাকে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম’ একটি রাষ্ট্রে পরিণত করার কল্পনায় বিভোর থাকার অধিকার তাঁহার আছে। গণতন্ত্র তাঁহাকে এই অধিকার দেয়। কিন্তু নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষদের দূরনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে হত্যা করার কাপুরুষতা ভারতীয় গণতন্ত্র তাঁহাকে মঞ্জুর করে না। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কি অনৈতিকও নয়? সমগ্র অসম যখন বন্যায় প্লাবিত, তখন তাঁহার অনুগামীরা দুর্গতত্রাণে হাত না লাগাইয়া দুর্গত-নিধনে ব্রতী? ইহার পরও তাঁহারা বিশ্বাস করেন, অসমবাসী তাঁহাদের ‘মুক্তিদাতা’, ‘পরিত্রাতা’ বলিয়া গণ্য করিবে? অসমিয়ারা যে ভারতীয়ত্ব হইতে মুক্তি পাইয়া আল্ফার সামরিক স্বৈরাচারের বশীভূত হইতে ব্যাকুল, এই তথ্যই বা তাঁহারা কোথায় পাইলেন? অসমিয়া জনসাধারণ তো তেমন কোনও বার্তা দেন নাই। কেবল তাঁহাদের সশস্ত্র হুমকি, স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরকের ভয়ে মৌনী রহিয়াছেন, এই মৌনকে তো সম্মতির লক্ষণ বলিয়া ধরিয়া লওয়া যায় না। ভীতি-প্রদর্শনের মধ্য দিয়া যে নিরুপায় ও বাধ্যতামূলক সম্মতি আদায় করা হয়, তাহা তো সম্মতি নয়। পরেশ বড়ুয়া নিয়ন্ত্রিত আল্ফা এমন জঙ্গি সংগঠন নয়, যাহারা রাজনৈতিক দাবিদাওয়া লইয়া জঙ্গি আন্দোলনের পাশাপাশি সম্প্রদায়ের কল্যাণ ও সেবামূলক ক্রিয়াকলাপেও আত্মনিয়োজিত করিয়া থাকে। বরং আল্ফার জঙ্গি ক্যাডাররা এই ধরনের স্বেচ্ছাসেবী কর্মীদের অতীতে হত্যা পর্যন্ত করিয়াছে। ইদানীং বড়ুয়া-অনুগামী জঙ্গিরা আবার ১৯৬২ সালের চৈনিক আগ্রাসনে নিহত ভারতীয় জওয়ানদের মৃত্যুর অর্ধশতক পূর্তিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের আয়োজনের বিরুদ্ধে হুমকিও দিয়াছে। বলা হইতেছে, ইহার ফলে নাকি অসমের সহিত চিনের সম্পর্ক খারাপ হইবে। পরেশ বড়ুয়ারা যে অসমের কল্যাণ অপেক্ষা চিনের তুষ্টিবিধানেই অধিকতর আগ্রহী হইবেন, ইহা হয়তো অস্বাভাবিক নয়। মায়ানমার হইতে বিতাড়িত হইবার পরে তাঁহাদের তো ইদানীং চিনের আশ্রয়েই থাকিতে হয়। আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক, গোলাবারুদও তো সেখান হইতেই মেলে। তাই চিন রুষ্ট হইতে পারে, এমন কিছু করিতে নিষেধমূলক হুঁশিয়ারি জারি করিয়া তাঁহারা ভারতীয় জওয়ানদের স্মৃতির প্রতি অশ্রদ্ধাজ্ঞাপনেও পরাঙ্মুখ নহেন। ‘সার্বভৌম অসম’-এর যথার্থ কাণ্ডারী বটে! |