...গন্ধ এসেছে
দ্রোণাচার্যদের হাত ধরে
‘টেনিয়াদের’ লক্ষ্যভেদ
চুঁইয়ে পড়া জলটাকে ঘূর্ণিপাকে ঘোরাবেন কী ভাবে, কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলেন না ভবতোষ সুতার। তা-বড় ইঞ্জিনিয়ারেরা ‘ফেল’ মেরে যাওয়ার পরে তাঁর অগতির গতি ‘অর্জুনে’র শরণাপন্ন হলেন ‘ভব’।
অর্জুনের আসল নাম চন্দন মিস্ত্রি। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতার জন্যই ভব তাঁকে অর্জুন বলে ডাকেন। ‘অর্জুন’ এ বারও টুথপেস্টের ছিপি, টিনের ঢাকনি কেটে পুরনো মোটরে বসিয়ে কী যেন করলেন, জলের ঘূর্ণি দেখে ভবতোষ নিজেই হতবাক।
অমর সরকারের ‘টেনিয়া’রাই বা কীসে কম! বছর দশেক আগে মিথিলা থেকে মধুবনী চিত্রকলার কাজ করতে অমরের টিমে যোগ দিয়েছিলেন শ্রাবণ পাসোয়ান। এখন মহারাষ্ট্রের ওরলি চিত্রকলার কাজ নামিয়ে ফেলাও শ্রাবণের কাছে নেহাতই জলভাত।
কিংবা মেদিনীপুরের অজ পাড়াগাঁর নকুল, শম্ভু, হারার দল। বছরভর গ্রামে জমিতে হাল চষে পুজোর মাস দু’-তিন আগে যাঁদের কলকাতায় আবির্ভাব। বাখারি কেটে কয়েকশো পদ্মফুল বা পাখি, মোটা-মোটা তার বেঁকিয়ে গোদনা পেন্টিংয়ের মোটিফ কিংবা প্লাস্টার অফ প্যারিসের কাজ— কোনটা চাই বলুন? অমর এক বারটি দেখিয়ে দিলেই নিমেষে রপ্ত করে ওঁরা তাক লাগিয়ে দেবেন।
পুজোর প্যান্ডেল-প্রতিমা বা থিমের জৌলুসে সাধারণত প্রধান শিল্পীই নায়কের মর্যাদা পেয়ে থাকেন। নেপথ্যচারী সহযোগীরা তাঁর আলোর ছটায় ম্লান। অথচ ভব নিজেই বলছেন, “আমাদের নাম সামনে এলেও অনেক কিছুই সহযোগীদের উপরে নির্ভর করে।”
পুজোর ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই কাব্যে উপেক্ষিতদের তুলে ধরার চেষ্টা এ বার শুরু হয়ে গেল। নামজাদা পুজোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘অখ্যাত’ কারিগরদের বিকাশের দরজা-জানলা খুলে দিতে এগিয়ে এসেছে কেন্দ্রের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পমন্ত্রক। লেকটেম্পল রোডে শিবমন্দির সর্বজনীনের ডাকে সাড়া দিয়ে একদল ‘টেনিয়া’কে স্বাধীন শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলতে তালিম শুরু করেছেন তাঁরা।
থিম-শিল্পী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত। কাছেই টালিগঞ্জ রোড, চন্দ্র মণ্ডল লেন কিংবা সুব্রতর নিজের পাড়া বন্ডেল গেট অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা অনেকেই ফি-বছর পুজোর কাজে ফাই-ফরমায়েশ খাটে। সন্দীপ-দেবাশিস, রাধা-অরুন্ধতীদের প্রথাগত তালিম নেই ছিটেফোঁটা। কিন্তু কী সহজে বছরের পর বছর কখনও কলাগাছ, বাঁশ কি অ্যালুমিনিয়াম পাত কেটেছেঁটে নানা কসরতে দিব্যি মানিয়ে নিচ্ছে। ‘স্বভাব-শিল্পী’দের এই প্রতিভায় শান দিয়ে তাঁদের স্বাধীন পেশাদার হিসেবে গড়ে তোলার ভাবনাটা তখন থেকেই কাজ করতে শুরু করে। সুব্রতর কথায়, “আমি নিজেও তো পাড়ার পুজোয় টেনিয়াগিরি করেই উঠে এসেছি।”
বাঙালির বারোয়ারি পুজোর সেরা শিল্পীদের অনেকে এ ভাবেই উঠে এসেছেন। তমলুকে পাড়ার কালীপুজো থেকে উত্থান গৌরাঙ্গ কুইল্যার। প্রশান্ত পালও নিজের পাড়া পোস্তার দর্পনারায়ণ স্ট্রিটে হাত পাকিয়েছেন। দু’দশক আগে পিকনিক গার্ডেনের সুনীলনগরে বন্দন রাহা, সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, তাপস কাঞ্জিলাল, দিলীপ দে, প্রদীপ দে, কিশোর দাসদের মতো ‘অনামা’দের মহাজোটই পুরস্কার ছিনিয়ে এনেছে। তখন প্যান্ডেলে বাটাম পেটানো, চট মারা, রং করা--- সব-কিছুই ওঁরা করতেন নিজের হাতে।
কেন্দ্রের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পমন্ত্রক বা মাইক্রো, মিডিয়াম অ্যান্ড স্মল এন্টারপ্রাইজেজ (এমএসএমই) দফতরের ডেভলেপমেন্ট ইনস্টিটিউটের কর্তা অজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “অল্পবয়সী ছেলেময়েদের কারিগরি দক্ষতাকেই আরও ধারালো করা হচ্ছে।” ছ’সপ্তাহের তালিমে কেন্দ্রীয় প্রকল্প, সরকারি ঋণের হাল-হদিসও মিলছে। পরিকল্পনা থেকে প্রতিটি পর্যায়ের খুঁটিনাটি শেখানো হচ্ছে। যাতে দক্ষ কারিগর থেকে স্বাধীন শিল্পী হয়ে উঠতে পারেন ওই তরুণেরা। অজয়বাবু বলছেন, “ভবিষ্যতে ওই ছেলেমেয়েরা বিয়েবাড়ি, শপিং মল, মেলার প্যাভিলিয়ন, পার্কের সাজসজ্জার মতো কাজও করতে পারবে।”
দীর্ঘদিন সুরুচি সঙ্ঘের পুজোর ‘টেনিয়া’ শ্যামল নাইয়া এখন স্বাধীন ভাবে কালীপুজো, সরস্বতী পুজো করেন। একদা সনাতন দিন্দার ‘ছায়াসঙ্গী’ বাপিও আলাদা ভাবে গোয়াবাগানের প্যান্ডেল করেছেন। প্রশান্ত পালের শাগরেদ সঞ্জয় বর্মণ এ বার জোড়াবাগানের দু’টি পুজোয় থিমের রূপকার। আর এক শাগরেদ বিকাশ ভক্ত নিমতলার একটি পুজোর ‘আর্টিস্ট’। এমএসএমই-র কর্তাদের মতে, এমন প্রতিভাবান ‘টেনিয়া’ আরও মিলবে। পুজো কমিটিগুলি চাইলে তাদের মাধ্যমেই তালিম পেয়ে উঠে আসবেন ভবিষ্যতের পেশাদার শিল্পীরা।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.