বিকেল ফুরোয়, আমি নেমে পড়ি
চিনের প্রতি বেসামাল রকমের দুর্বল হলেও আজীবন দরদি পণ্ডিত নেহরু এই অসহায় এবং বিশ্বাসী মানুষগুলোকে ফেরাতে পারেননি। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সংঘাত এড়াতে বেছে বেছে জনশূন্য এবং ঈষৎ পাহাড়ি এলাকায় জমি দেওয়া হয় তাঁদের। যেহেতু তিব্বতিরা খুবই উদ্যোগী লোক এবং সর্বহারা রিফিউজির পেশিতে আলাদিনের দৈত্য ভর করেই, তাই চোখের পলকে জংলা প্রান্তরে মাথা তোলে পাকাপোক্ত শরণার্থী শিবির। পোড়ো জমি হয়ে ওঠে আবাদি। সাত পুরুষে চাষ-আবাদ না শিখলেও পরিস্থিতির দাবিতে এঁরা হয়ে ওঠেন পোক্ত চাষা। এখন পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার তিব্বতি শরণার্থী ৪২টা ক্যাম্পে ঘর বেঁধেছেন। স্থানীয় সংসর্গ এড়িয়ে চলায় এই এত বছর পেরিয়েও শিবিরগুলো ভাষায়-পোশাকে-আচারে তীব্রতম তিব্বত। সাবেক তিব্বত টুকরো টুকরো হয়ে বেঁচে আছে প্রায় লুকোনো কিছু প্রবাসী উপত্যকায়। সবচেয়ে বড় টুকরোটা কর্নাটকের এই বাইলাকুপ্পা।
বেবাক ফাঁকা মাঠের ওপর প্রথমেই চোখে পড়ল একটা পাথর। তার গায়ে বৃষ্টিধোয়া পোস্টারে এক দুষ্টু ছেলের আবছা মুখ। পাথরের গায়ে সাদা হরফে লেখা ‘China, give back our Panchen Lama.’ দলাই লামা মনোনীত পাঞ্চেন লামার এই পুনর্জন্মকে ক’বছর আগে চিন স্রেফ ভ্যানিশ করে দিয়েছে। বালক তাই থেমে গেছে বালকেই। পাথরের পাশ দিয়ে দীর্ঘ রাস্তাটা উপত্যকায় নেমেছে। বাঁকাচোরা-এলোমেলো-উঁচুনিচু রাস্তায় চার কিলোমিটার হাঁটলে পাব প্রথম শিবির, যেখানে শুনেছি একটা গেস্ট হাউসও আছে। খান তিনেক বাঁক নিতেই চোখে পড়ে একা অশ্বত্থ, তার পিছনে নীলে নীল মেশা হালকা আউটলাইন পাহাড়ের। অশ্বত্থের নীচে শেষ রোদ্দুরে ঠিকরোচ্ছে একটা বাজাজ পালসার। পাশে, ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে এক জন মানুষ। ব্যাগ-কাঁধে বেকুবের মতো এই দূরত্বটা পেরিয়ে আসার সময় আমাকে দিয়ে সে উঠে বসে। নাম বলে পালদেম।
তিন দিন পরে ঠিক এই সময়ে এবং এই অশ্বত্থের নীচেই পালদেম আমাকে ওর দুঃস্বপ্নের গল্প বলবে।
কেন অসহায় আর্তি থেকে শরণার্থী হারানো মাটিকে জাগিয়ে তুলতে চায় নতুন মাটিতে? লাসার তিন প্রধান মনাস্ট্রির নামে বাইলাকুপ্পা শিবিরের তিন মনাস্ট্রির নাম সেরা, দ্রেপুং, গানতে। শুধু সেরাতেই আবাসিক সন্ন্যাসীর সংখ্যা ৫০০০-এর কাছাকাছি। লাসার মূল মন্দির জাখাং-এর অনুকরণেই এলাকার নতুন মন্দির নামদোলিং বা সোনার মন্দির। আদ্যন্ত ভারতীয় সবুজে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে নিষিদ্ধ মরুপাহাড়ের যাবতীয় অনুষঙ্গ মঠের উঠোনে লামাদের প্রবল দেহাশ্রয়ী শাস্ত্রতর্ক, দেওয়ালে দেওয়ালে করালদংষ্ট্রা বজ্রপাণি এবং ধ্যানী অমিতাভ, নিস্তব্ধ নানারি-র স্তব্ধ অন্ধকার, আবছায়ায় শালু-মোড়া পুঁথি ও ঘিয়ের প্রদীপ। প্রকাণ্ড স্তূপগুলো ঘিরে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা পাক খেয়ে যান সারাদিন, সন্ধের মুখে হাওয়ায় ভর করে বহুদূর বুকে হেঁটে যায় শিঙার বিষণ্ণ ভো।ঁ ঝকঝকে চৌকো সাদা কিছু বাড়ির জটলা নিয়ে এক একটা পাড়া। এই পাড়াগুলোকে বলে কাংস্তেন পালদেম আমাকে বলেছিল। এক এক কাংস্তেন-এ তিব্বতের এক এক প্রদেশের মানুষ বাসা বেঁধেছেন। প্রাদেশিক বৈষম্যের খোঁজ এই পরবাসেও?
এবং প্রাচুর্য খেত-ভাসানো ফসল, দোকান-ঠাসা কনজিউমারিজম, বাইক-বিঘ্নিত গলিঘুঁজি। যাযাবরের ঘোড়ার বিকল্প এই এপারের আধুনিক কালে অবশ্যই মোটরবাইক। এবং অবশ্যই শরণার্থীর ক্রয়ক্ষমতা আমভারতীয়র ক্রয়ক্ষমতাকে বহু যোজন পিছনে ফেলেছে। কী ভাবে? পালদেমই বলল সংঘের কারণে। অর্থাৎ, আমআদমির কমন দর্শন, একই প্রজ্ঞা এবং পরিমিতিবোধ। সোজা কথায়, বুদ্ধের সারল্য-মাখা নির্দেশে এক সহজ প্রণালী জীবনের। খেত-খামার-মনাস্ট্রিতে সারাদিন টহলের পর সন্ধের মুখে-মুখে অশ্বত্থের নীচে মুখোমুখি বসতাম আমি আর পালদেম। এক্কেবারে জীবন থেকে নেওয়া ওর টুকরোটাকরা নীতিকথায় আমার জ্ঞানচক্ষু খুলত।
আসলে আমাকে টানত পালদেমের প্রজন্ম। যাদের ধম্মো ও-দেশে, কম্মো এ-দেশে। ক্যাম্পের একেবারে চ্যাংড়াদের ধম্মোকম্মো সবই বোধহয় চেলসি এবং শাহরুখ। ওদের ঘাঁটিয়ে লাভ হত না কোনও। আমার প্রশ্নে পালদেমের মাঝবয়সি কপালে অনেকগুলো ভাঁজ থেমে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে বলে ‘আমার জন্ম তিব্বতেই। ঠাকুমার কাছে থাকতাম। পালিয়ে এসেছি, তাও বছর কুড়ি হল।’
‘চিনাদের চোখরাঙানিতে বুদ্ধ সম্পর্কীয় দৈবিক-দানবিক সমস্ত নিশানা লুকিয়ে ফেললেও ঠাকুমার স্তব থামেনি কখনও, প্রায় প্রত্যেক রাত্তিরেই ঠাকুমার আর্তচিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে যেত। তাকিয়ে দেখতাম বুড়ি কাঁপতে কাঁপতে মালা জপছে পাগলের মতো।’
‘ঠাকুমা মারা যাওয়ার তিন দিন পরে আমিও মাঝরাত্তিরে চিৎকার করে জেগে উঠি। স্পষ্ট দেখলাম শুধু আগুন আর আগুন। আর নেপথ্য হাহাকারের মাঝখানে পুড়ে যেতে যেতে আর পুড়ে যেতে যেতে বজ্রপাণি শ্বদন্ত বের করে বজ্রহাসি হাসছেন। ওই একই স্বপ্ন আমি এক দিন দেখি, তিন দিন দেখি, পাঁচ দিন দেখি। বুঝি, বুড়ি আমাকে তার দুঃস্বপ্নটা দিয়ে চলে গেছে।’
‘দগ্ধ ঈশ্বরের মুখোশকে চ্যালেঞ্জ করে একটা বালকবয়স কেটে গেল। তারপর পালালাম। অন্তত সতেরো ঘাটের জল খেয়ে এপারে এলাম। তারপর ঠোক্কর খেতে খেতে আমার মধ্যবিত্ত হওয়া, গৃহস্থ হওয়া, সামাজিক হওয়া। আর ওই ছোট্ট ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি, আমার নিজের। এক আয়ুষ্কালেই বহু প্রজন্মের দুঃস্বপ্নের গভীরে গেছি আমি। পুরনো কথা মনে পড়লে বাইকে আর একটু স্পিড তুলি, স্মৃতি-ফৃতি হাওয়া হয়ে যায়।’
পরদিন পালদেমের পালসারে চেপে হাইওয়ের মুখটাতে এসে আমি মাদিকেরি মাইসোর ভলভো ধরি। পিছনে তাকিয়ে বহুক্ষণ দেখতে পাই পাথরের গায়ে এক নিখোঁজ বালকের অস্পষ্ট মুখ। একটা পালসার। এবং একক আরোহী। স্বেচ্ছাচারী বৃষ্টি তাকে ভেজায়, আগুন নেভায়।

ছবি: লেখক



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.