|
|
|
|
পুজোর টেম্পোরারি শিল্পপতিরা |
বিরিয়ানির হাঁড়িতে টপটপ জল: বরুণদেবতার গ্যাঁড়াকল। চিকেন পকোড়া বাড়ির লোকেরা
সাঁটিয়ে দিল: পরিবারের ষড়যন্ত্র। ক্যাশবাক্সে দু’আনি চারআনি। তবু বাঙালির টেম্পোরারি
বেওসার প্রতিভা লুক্কায়িত রাখতা পারবা না। জানাচ্ছেন দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত |
একটা ঘরে আলোচনা চলছে। সবার মাথা নিচু, বিড়বিড় করে কথা বলছে সকলে, প্রয়োজনে চলছে সাংকেতিক কোড। দেখে মনে হবে, হয় এরা উগ্রপন্থী, নয় যোগেশ দত্তের ছাত্র। ইশারাতেই সিদ্ধান্ত। দু’একটা কথা যদিও বা বলছে, বাকিরা চোখ পাকাচ্ছে: আস্তে বল, আস্তে। এরা চায় না আলোচনা শুনুক পাশের ঘর, তারা জানবে শুধু ডিসিশনটা। ‘আমরা করছি।’ এ ঘরের সবাই পুরুষ।
একটা ঘরে আলোচনা চলছে। সবার মাথা উঁচু, আওয়াজও। ভাষা না বুঝলে মনে হবে নর্মদা বাঁচাও-এর ধর্নামঞ্চ। কেউ যদি ভুলেও বলে, ‘একটু আস্তে কথা বল না, পাশের ঘরে ওরা আছে না?’ তখনই একগুচ্ছ গলা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘আরে, ওদের শোনাব বলেই তো জোরে বলছি, ওরা সবটা না জানলে চলবে?’ এ ঘরের সবাই মহিলা।
উপলক্ষটা একই। দু’দলই ভাবছে, পুজোয় ক’জন বন্ধু মিলে খাবার স্টল দেওয়া। মুখে বলছে, চারটে দিন একটু একসঙ্গে থাকব, হইহই করব, জনসংযোগ। ঘরে বা অফিসে বাকি ৩৬১ দিন থোড় বড়ি খাড়া। ও দিকে ক্যালকুলেটর স্পষ্ট হিসেব দেখিয়েছে, চার দিনে মিনিমাম প্রফিট ১৬ হাজার টাকা। এই হিসেব কষতে গিয়েই আমরা প্রথমে আবিষ্কার করি, খাবারের ব্যবসায় ডবল প্রফিট হয়। আর আমাদের পায় কে। ত্রিপল-চেয়ার-টুনি-টিউব-ছোট্ট সাউন্ড বক্স, সব ভাড়া হল। এক দিন বিগ বাজার বা স্পেনসারে ঢুকে কেনাকাটি, তার পর দিন গোনা। মা কবে আসবে। বসের ধ্যাতানি নেই। এ ব্যবসায় আমিই বস।
পুজো আসে, পুজো যায়। দশমীতে মা চলে গেলেই কারও মুখে অমাবস্যা তো
কারও পূর্ণিমা।
‘যা ভেবেছিলাম, ১২ হাজার ভেবেছিলাম প্রফিট হবে, হয়েছে ১১,৭০০, এটাকে ৪ দিয়ে ভাগ হবে।’ হেসে হেসে এ ঘোষণা মহিলাদের।
‘ব্যাড লাক, যা ইনভেস্ট করেছি তার ৪০ পার্সেন্ট ফেরত পেয়েছি। প্রফিট করব বলে তো নামিনি, যে প্রশংসা পেয়েছি, সেটার দাম টাকায় হয় না।’ ব্যাজার মুখে এ স্টেটমেন্ট পুরুষদের।
কেন এমন হয়? কেন মেয়েরাই জিতে যায়? এর একটা কারণ যদি হয় যে, পাড়ার লোক বাকি রাখতে কিন্তু-কিন্তু করেন তো অন্য কারণ হল অমুক বউদি, তমুক মাসিমা দোকান দিয়েছে, অথচ আমি এক বারও না গেলে, না খেলে খারাপ দেখায়। তাই ভিড় হবেই। অল্পবয়সি মেয়েরা দোকান দিলে আবালবৃদ্ধদের ঢল নামে, স্নেহের সুনামি। ‘ফুলের মতো মেয়েগুলো ঠাকুর দেখতে না বেরিয়ে কেমন পাড়ার কথা ভেবে দোকান দিল,’ আর ওই বয়সের ছেলেরা দোকান দিলেই সংক্ষিপ্ত সংবাদ: ‘কেন দোকান দেয় বোঝ না? যত সব বদ বুদ্ধি।’ বয়স্করা দোকান দিলেও লোকে জ্ঞান ফ্রি পাবার ভয়ে ও-পথ মাড়ায় না। অন্য দিকে, মহিলারা নিজের নিজের বর’কে ঘরে সেদ্ধ খাওয়ালেও এ ক’দিন গোটা পাড়াকে তেল-চুপচুপে ফ্রাই খাওয়ায়। ‘এক দিন খান তো মনোজদা, কিচ্ছু হবে না। এখনও আপনি যথেষ্ট ইয়াং।’ ব্যস্, এক কথায় মনোজদা তখন অক্টো-প্রজাপতি। আট পায়ে ছুটছে, দু’ডানায় উড়ছে। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
তার পর বাড়ি ফিরে লুকিয়ে আড়াই পেগ জোয়ানের আরক।
আশুতোষ কলেজের সুশান বকুলবাগানে এগরোলের দোকান দিয়েছিল। চার দিন দিনরাত খেটে ২৬ টাকা প্রফিট। পরের বছর থেকে আর ব্যবসা নয়, সে গিয়ে ২৩ পল্লির বামপন্থী বই-এর স্টলে বসত।
বিবেকানন্দ রোডের অভিজিৎ বসু দিয়েছিল কোল্ড ড্রিংকস আর আইসক্রিমের দোকান। বৃষ্টিতে এক কোমর জল। দশমীর পর ভর্তি বোতল ফিরে গেল, আইসক্রিম গলে দুধ। সে শুধু ভাবছে, এটা দিয়ে কি দুধ-চা খাওয়া সম্ভব? সেই দুঃখ ভুলতেই এখন সে বহুজাতিক চা-কোম্পানিতে চাকরি করে।
শহর-এর অনিন্দ্য বোস কলেজবেলায় দিয়েছিল রোলের দোকান। রোলটাকে রোলের মতো হতে ৩০টা লেচি শহিদ হল, বাড়ি থেকে আনা কাশ্মীরি কাঠের ক্যাশবাক্স ফাঁকা। লজ্জা ঢাকতে নিজেই কিনে খেয়ে দাম দেয়, ক্যাশবাক্সে টাকা পড়ে। ষষ্ঠী আর সপ্তমী। সব রোল নিজেরাই খেয়ে অষ্টমী-নবমী বিছানায়। সে দুঃখ ভুলতেই অনিন্দ্য এখন চিত্রনাট্য লেখে আর লোককে রোল দেয়।
গায়ক সুরজিৎ ভবানীপুরে দিয়েছিল টিপ করে নারকেল ফাটানোর দোকান। উদ্বোধনের আগের রাতে হাজার প্র্যাকটিসেও একটা নারকেলও ফাটেনি। বড়লোক হওয়া ছিল সময়ের অপেক্ষা। ষষ্ঠী থেকে ঘটল উল্টো কেস। যে আসছে সে-ই ফাটাচ্ছে। সপ্তমীতে দাঁড়ানোর জায়গা চার হাত পিছল, তাতেও আটকানো গেল না। অষ্টমীতে আরও ছ’হাত, তাতেও নিস্তার নেই। কোনও মতে বাড়ি থেকে টাকা এনে ধারদেনা মিটিয়ে নবমীতে সুরজিৎরা ঠাকুর দেখতে চলে গেল।
আমার বাবা, লেখক বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, আরও কয়েক জন মিলে কোনও এক মেলায় দোকান দিয়েছিলেন, নাম ছিল খাই খাই। লোকজন কে কত মেলায় খেয়েছে, জানি না, তবে আমরা বাড়িতে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার সব সেরেছি পুলিপিঠে দিয়ে। সব মিটে যাওয়ার পরেও বাবারা কত সন্ধেয় আমাদের বাড়িতে আলোচনায় বসতেন। কী করে লোকসান হল এই ভেবেই তাঁরা আকুল হতেন। মা ব্যাজার হত। বার বার চা করার চাপ ছিল তার।
এমন ঘটনা হাজার আছে। উল্টো ঘটনা আছে খান পাঁচ। মোটামুটি ভাবে এ কথা বলাই যেতে পারে, পুরুষদের কপালে হঠাৎ শিল্পপতি হওয়াটা পুজোয় নেই।
তবু এ বছর গল্ফ ক্লাব রোডের রাণাদা-ঘেঁটুরা প্ল্যান করেছে বিরিয়ানি আর চাপের দোকান দেবে। আমাকেও দলে চাইছে।
আমার এক বন্ধুর মধ্যবয়স্ক কাকা হাবড়ার হিজলপুকুরের পুজোতে খাবার স্টল দেবে বলে এখন দিবারাত্র বেলা দে’র বই পড়ছে। আমাকে এক দিন খেয়ে আসতে বলেছেন।
আমি পুজোয় এক দিন হাবড়াতেও যাব আর পাড়ার স্টলেও লগ্নি করব। ওই যে এক জন বলে গেছেন সম্ভবামি যুগে যুগে। |
|
|
|
|
|