সাহায্য ছাড়াই পরিবেশকে আদর অঙ্গামিদের
পাহাড়ের ঢালে পর পর ছিপছিপে অল্ডার গাছ। গাছের গায়ে যত্ন করে হাত বুলিয়ে উপজাতি ভাষায় কী যেন বলছিলেন বছর তিরিশের মহিলা। দোভাষী নিউরেথো কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “আদর চলছে। গাছেদের শরীরের খোঁজখবর নিচ্ছেন।”
গাছ এঁদের কথা শোনে?
নিউরেথো মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “শোনে তো! পাখির সঙ্গেও ওঁরা কথা বলেন! প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই রকমই চলছে।”
নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বরাইল পাহাড়ে ঘেরা খোনোমা গ্রাম। প্রায় ৩ হাজার মানুষ থাকেন। অধিকাংশই অঙ্গামি উপজাতির। প্রধান জীবিকা চাষবাস। ‘ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স’-এর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিডিয়া ট্যুরের শরিক হয়ে সকাল-সকাল পৌঁছনো গিয়েছিল সেখানে। ছবির মতো গ্রামে ঘুরছে প্রায় চড়ুই পাখির মতো বড়-বড় প্রজাপতি। চারদিকে মেঘের সাম্রাজ্য, নাম-না-জানা থোকা-থোকা পাহাড়ি ফুল, বুনো আপেল, প্লাম, অর্কিডের রাজত্ব।
নিজেরাই রাস্তা তৈরি করছেন খোনোমার গ্রামবাসীরা। —নিজস্ব চিত্র
তবে ৭০০ বছরের পুরনো খোনোমা গ্রামের আসল গল্পটা অন্য জায়গায়। খোনোমার সঙ্গে কোথায় যেন মিলেমিশে গিয়েছে জেমস ক্যামেরনের ‘অবতার’ ছবির ঘন অরণ্যে ঢাকা গ্রহ ‘পান্ডোরা’। সেই গ্রহের অধিবাসী ‘নাভি’রা প্রকৃতির উপাসনা করত। তারাও গাছের ভাষা বুঝত, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আত্মিক সম্পর্ককে সবচেয়ে গুরুত্ব দিত। ছবির সেই ‘নাভি’দের মতোই বাস্তবের খোনোমার অঙ্গামিরা আধুনিকতার অভিঘাত থেকে তাঁদের প্রকৃতি আর পরিবেশের ‘সতীত্ব’ রক্ষা করে চলেছে যুগের পর যুগ। গত বারো বছরে গ্রামের চারপাশে ৩০ বর্গ কিলোমিটার জায়গায় তাঁরা তৈরি করে ফেলেছেন সংরক্ষিত অরণ্য। পাইন, ফার, টিক, গুসবেরি গাছের সেই জঙ্গল এখন অজস্র কীট-পতঙ্গ, পশুপাখির আস্তানা।
নিজেদের চেষ্টাতেই পরিবেশ রক্ষার লড়াই চালাচ্ছেন অঙ্গামিরা। কোনও প্রচারাভিযান দরকার হয়নি। সরকারকে এতটুকু সাহায্যও করতে হয়নি। পরিবেশ-বাঁচানোর পোস্টার লাগাতে হয়নি। সেমিনার করে প্রকৃতি-পাঠের আসরও বসাতে হয়নি। নাগাল্যান্ডের পর্যটন বিভাগের অধিকর্তা কে ইয়ানতানথুং বলছিলেন, “খোনোমার উপজাতিরা নিজেরাই সেই আদ্যি কাল থেকে জঙ্গল রক্ষা করে। কোনও সরকারি সাহায্য নেয় না।” পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে খোনোমাকে ‘মডেল গ্রাম’-এর তকমা দিয়েছে নাগাল্যান্ড সরকার।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাতেও অঙ্গামিরা সমান সচেতন। গ্রামের পাশে জঙ্গলে এক সময় ঝাঁকে-ঝাঁকে ‘ব্লিথস ট্র্যাগোপ্যান’ আসত। অনেকটা বড় পায়রার মতো চেহারার পাখি। গলাটা লাল, গায়ের চামড়া হলদেটে-খয়েরি, তার উপর বুটি-বুটি দাগ। এই অঞ্চলের মানুষের প্রিয় খাবার। অঙ্গামি শিকারিদের হাতে মারা পড়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল পাখিগুলি। এটি যে পরিবেশের পক্ষে শুভ নয়, তা বুঝতে পারেন খোনোমা গ্রামের মানুষেরা। তাই এই ঘটনা ঠেকাতে ১৯৯৮-এ গাঁওবুড়ো গ্রামের প্রত্যেককে আলোচনায় ডাকলেন। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হল, ট্র্যাগোপ্যান আর মারা হবে না। শিকার বন্ধ। কোনও সরকারি হস্তক্ষেপ দরকার হল না। কয়েক বছরের মধ্যে জঙ্গলে ট্র্যাগোপ্যানের ঝাঁক আবার ফিরে এল।
এখানেই শেষ নয়। গ্রামের লোকই পালা করে দায়িত্ব নিয়ে তৈরি করেছেন পাকা শৌচাগার। খাবার জলের জন্য নালা কেটে ঝরনার স্বচ্ছ জল নিয়ে আসা হচ্ছে গ্রামে। রাস্তার ধারে ধারে বসানো হয়েছে জঞ্জাল ফেলার বেতের ডালা। সপ্তাহে একদিন সব জঞ্জাল এক জায়গায় পুড়িয়ে ছাই করা হয়। সেই ছাই ব্যবহার করা হয় সার হিসেবে। ঝুম চাষে ২০ রকম ধান ফলানো হয় খোনোমায়। আর সেই ঝুম চাষের জেরে অবশ্যম্ভাবী ভূমিক্ষয় আটকে দেওয়া হয় একের পর এক অল্ডার গাছ লাগিয়ে।
অঙ্গামিদের এই ‘মডেল গ্রাম’-এ ঢোকার মুখে ডান দিকে একটা ছোট্ট মুদিখানা। মুদিখানার সামনে টুলে বসে দুলে-দুলে কথা বলছিলেন বছর সত্তরের টসিলি সাখরিয়ে। গ্রামের মাথাদের অন্যতম। ষাটের দশকে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে পাশ করেছেন। ফোকলা দাঁতে হেসে বলেন, “সরকারের দরকার নেই। আমরা জানি আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে।”
গ্রামের ধবধবে সাদা বাঁধানো রাস্তায় ঘুরতে-ঘুরতেই দেখা হল আভানা, আতুলা, আতসুনুও, মেনো-দের সঙ্গে। কেউ রাস্তার ধারে ঘাস তুলে সাফ করছেন, কেউ গাছের পাতা, রাস্তার পাশে তৈরি সিঁড়ির ধাপ ধুয়ে দিচ্ছেন, কেউ গ্রামের ভাঙা রাস্তা সারানোর কাজে হাত লাগিয়ে মাথায় করে পাথর বয়ে আনছেন। সবটাই বিনা পয়সায়। গ্রামের স্বার্থে, দৈনিক কাজের পর অবসর সময়ে নিজেদের ইচ্ছায়।
প্রত্যন্ত খোনোমার অখ্যাত উপজাতিদের কাছ থেকে পরিবেশকে আদর করতে শিখছে আধুনিক সভ্যতা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.