সর্বভারতীয় তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান সর্ব বিষয়েই মাঝামাঝি অথবা পিছনের সারিতে। এই পরিচিত সত্যটি মনে করাইয়া দেওয়ার জন্য দুঃখিত। তবে খেদ করিবেন না, ব্যতিক্রম আছে। সারা দেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের পরিসংখ্যানে রাজ্যের স্থান শীর্ষে। এবং সেই অপরাধ যদি ধর্ষণ হয়, তবে গত আট বছর ধরিয়াই অর্থাৎ ২০০৪ সাল হইতেই পশ্চিমবঙ্গ তাহাতে স্বর্ণপদকের দাবিদার। রৌপ্য পদক ঝুলিবে মধ্যপ্রদেশের গলায়। জাতীয় স্তরে ধর্ষণ এবং শ্লীলতাহানির মতো অপরাধ যদি শতকরা ত্রিশ ভাগ হারে বৃদ্ধি পাইয়া থাকে, পশ্চিমবঙ্গে তবে সেই বৃদ্ধির হার ৬০ শতাংশ। এ সব কোনও সাজানো প্রচার নয়, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক রচিত ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান। ছয়-সাত-আট বছরের শিশু হইতে শুরু করিয়া আশি বছরের বৃদ্ধা, ছাত্রী, গৃহবধূ, পরিচারিকা, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী কেহই এই ধর্ষকদের হাত হইতে রেহাই পাইতেছেন না।
মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যাবৃদ্ধি রাজ্যের বর্তমান সরকারের আমলের একান্ত বিষয় নয়, এই ঐতিহ্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পরিচালিত বামফ্রন্ট জমানার। তবে ঐতিহ্যটি বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর একচ্ছত্র কর্তৃত্বাধীন ‘পরিবর্তন’-এর সরকার কায়েম হওয়ার পরেও অপরিবর্তিত। এবং পূর্ববর্তী জমানার মতোই এখনও বারংবার প্রকট হইতেছে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের প্রশ্রয়মূলক কথাবার্তা ও আচরণ। ধর্ষণই একমাত্র অপরাধ, যেখানে সমাজ অপরাধীকে নয়, অপরাধের শিকারকে দায়ী করিয়া থাকে। তাই ধর্ষিতার পোশাক উত্তেজক ছিল কি না, তিনি নির্জন রাস্তা দিয়া সন্ধ্যার পর অভিভাবকহীন যাইতেছিলেন কি না, ‘অত রাত্রে কেনই বা পানশালায় গিয়াছিলেন’ ইত্যাকার প্রশ্ন তুলিয়া অপরাধের শিকারকে বিদ্ধ, জর্জরিত করা হয়, যাহাতে ধর্ষককে পাকড়াও করিয়া শাস্তি দিবার প্রশাসনিক অভিমুখটি সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে ঘুরিয়া যায়। রাজ্যের বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের, শাসক দলের নেতানেত্রীদের এ ধরনের প্রশ্ন করিতে এবং ধর্ষিতার বয়ানের সত্যতা লইয়া সংশয় ব্যক্ত করিতে কিংবা বয়ানের অসঙ্গতির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিতে দেখা গিয়াছে। ধিক্কারজনক এই প্রবণতা ধর্ষকদের আরও সাহসী, পরিণামভয়হীন ও বেপরোয়া করিয়াছে, এমন অনুমান অসঙ্গত নয়।
পুলিশের কাছে ধর্ষিতা কিংবা শ্লীলতাহানির শিকার মহিলাদের করা অভিযোগের সারবত্তা লইয়া মন্ত্রীদের তোলা সংশয় প্রশাসনকেও দুষ্কৃতীদমনে তৎপর না করিয়া তাহার হাত-পা বাঁধিয়া দিয়াছে। কোনও বিবেকী পুলিশ অফিসার আইনের স্বাভাবিক সহমর্মিতা লইয়া তদন্তকার্যে অগ্রসর হইলে তাঁহাকে নানা ভাবে নিরুৎসাহ করা হইয়াছে। সামাজিক ‘কলঙ্ক’-এর ভয়ে অধিকাংশ মহিলাই যে ধর্ষিত হইয়াও শেষ পর্যন্ত পুলিশে নালিশ করার সাহস সঞ্চয় করিয়া উঠিতে পারেন না, এই নির্মম ও বেদনাদায়ক সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অসংবেদী না হইলে কোনও প্রশাসকের পক্ষে অভিযোগকারিণীর বয়ান লইয়া সংশয় ব্যক্ত করা কিংবা তাহাকে সরকার-বিরোধী চক্রান্ত রূপে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, এই রাজ্যে ক্ষমতাসীনরা অনেকেই ধর্ষিতার প্রতি সেই অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গিই গ্রহণ করিয়াছেন। মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনকে তৎপর করুন, সচেতন করুন। তাহা না হইলে তিনি যত অসন্তুষ্টই হউন, পরিসংখ্যানের লিখনকে অস্বীকার করিতে পারিবেন না। |