ঠিক পাঁচ বছর আগের একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু। তাকে ঘিরে রাজ্যে তোলপাড়, রাজনীতিতে আলোড়ন, মোমের শিখা জ্বালিয়ে সামাজিক আন্দোলনের নতুন ধারার সৃষ্টি। এমনকী, পদস্থ পুলিশ অফিসারদের হাজতবাসও। এ ভাবেই রিজওয়ানুর রহমান নামটি আজ ‘প্রতিবাদের প্রতীক’ হয়ে উঠতে পেরেছে। কিন্তু একের পর এক আইনি টানাপোড়েনে সেই রিজওয়ানুরের মৃত্যু-মামলার শুনানি পাঁচ বছর পরেও শুরু হল না!
২০০৭-এর ২১ সেপ্টেম্বর পাতিপুকুরের রেললাইনের ধারে পাওয়া গিয়েছিল রিজওয়ানুরের দেহ। এর এক মাস আগে, ১৮ অগস্ট একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্রের শিক্ষক রিজওয়ানুর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সম্পন্ন ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে প্রিয়ঙ্কা তোদির। তোদি পরিবার সেই বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। রেজিস্ট্রির ক’দিন বাদে প্রিয়ঙ্কা পার্ক সার্কাসে শ্বশুরবাড়ি চলে যান। অভিযোগ, এর পরে পুলিশ ও আরও কিছু লোকের সাহায্য নিয়ে তোদি পরিবারের পক্ষ থেকে ‘চাপ’ তৈরি করা হয় রিজ ও তাঁর পরিবারের উপরে। ৮ সেপ্টেম্বর প্রিয়ঙ্কা সল্টলেকে বাপের বাড়ি ফিরে যান। এর দু’সপ্তাহ পরে মেলে রিজের দেহ।
তদন্ত করে ঘটনার এক বছর পরে সিবিআই চার্জশিট জমা দেয়। চার্জশিটে বলা হয়, রিজওয়ানুর আত্মহত্যা করেছিলেন, এবং তাঁর আত্মহত্যার পিছনে ছিল নির্দিষ্ট প্ররোচনা। সেই চার্জশিটের ভিত্তিতে ২০১১-র এপ্রিলে নিম্ন আদালত চার্জ গঠন করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। এর মাঝেই নিম্ন আদালত থেকে কলকাতা হাইকোর্ট, এমনকী সুপ্রিম কোর্টও ঘুরে এসেছে এই মামলা। একের পর এক কারণ দেখিয়ে অভিযুক্তেরা বার বার আদালতের দ্বারস্থ হওয়ায় আসল মামলার শুনানি এখনও শুরু করা যায়নি বলে সিবিআইয়ের অভিযোগ। |
তোদি পরিবারের আইনজীবী দীপনারায়ণ মিত্রের পাল্টা অভিযোগ, “সিবিআই যে চার্জশিট দিয়েছে, তা অত্যন্ত নিম্নমানের। তার ভিত্তিতে কাউকে প্ররোচনায় অভিযুক্ত করা যায় না।” এই যুক্তি দেখিয়েই গত বছরের এপ্রিলে আবার হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয় তোদি পরিবার। তোদিদের দু’ভাই ছাড়াও তাঁদের আত্মীয় অনিল সারোগী এবং রিজের প্রতিবেশী পাপ্পু এই ঘটনায় অভিযুক্ত। অন্য দিকে যে তিন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে সিবিআই ‘প্ররোচনা’র অভিযোগ এনেছিল, সেই অজয় কুমার (আইপিএস), সুকান্তি চক্রবর্তী এবং কৃষ্ণেন্দু দাসের বিরুদ্ধে প্ররোচনার অভিযোগ খারিজ করে দেয় নিম্ন আদালত। সেই কারণে সিবিআই-ও হাইকোর্টে গিয়েছে। এর মাঝে এঁরা প্রত্যেকেই কম-বেশি হাজতবাস করেছেন।
রিজের মৃত্যু নিয়ে সিবিআই-তদন্ত দাবি করেছিল রিজের পরিবার। অথচ সিবিআইয়ের চার্জশিট জমা পড়ার পরে তাঁরাও সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে অভিযোগ জানিয়েছেন। ওঁদের দাবি, মামলায় কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায় ও আর এক আইপিএস অফিসার জ্ঞানবন্ত সিংহ জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
চার্জশিটে জ্ঞানবন্তের নাম না-রেখে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করেছিল সিবিআই। যার জেরে এখনও তাঁর পদোন্নতি আটকে রয়েছে। দীপনারায়ণবাবুর কথায়, “মৃত্যুর আগে লেখা রিজওয়ানুরের লেখা শেষ চিঠি বলে সিবিআই যা আদালতে পেশ করেছে, সেখানে রিজওয়ানুর অভিযোগ করে গিয়েছিলেন জ্ঞানবন্ত, তৃণমূল বিধায়ক জাভেদ খান আর নিজের কাকা সহিদুর রহমানের নামে। অথচ তাঁদের নাম তো চার্জশিটে নেই!” ২৫ সেপ্টেম্বর রিজ-মামলার শুনানি রয়েছে হাইকোর্টে।
ইতিমধ্যে রিজ-কাণ্ড ঘিরে ‘রাজনীতির’ হাত ধরে রিজের দাদা রুকবানুর রহমান এখন তৃণমূলের বিধায়ক। আর প্রিয়ঙ্কার বর্তমান ঠিকানা তাঁদের সল্টলেকের বাড়িই। তোদি পরিবারের ঘনিষ্ঠমহলের খবর, প্রিয়ঙ্কা আপাতত পারিবারিক ব্যবসা দেখভাল করছেন। তাঁর বাবা অশোক তোদি ও কাকা প্রদীপের একটি ব্যবসায়িক অফিস রয়েছে রাজারহাটে। প্রিয়ঙ্কা দিনের অনেকটা সময় সেখানে বসেন।
এ দিকে রিজের মৃত্যুর পরে রেল-পুলিশের যে অফিসার তদন্তের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সেই অরিন্দম মান্নার দেহ রেললাইনের ধারে পাওয়া যায় ২০০৯-এর ১১ ফেব্রুয়ারি। তাঁর পরিবার অভিযোগ করে, রিজ-কাণ্ডে তদন্তের জন্যই অরিন্দম খুন হয়েছেন। রাজ্য গোয়েন্দা-পুলিশ জানায়, ঘটনাটি আত্মহত্যার। এই যুক্তি না-মেনে অরিন্দমের পরিজনেরা আদালতের দ্বারস্থ হন। কোর্টের নির্দেশে ওই মামলারও ফের তদন্ত শুরু হয়েছে। |