প্রতিবাদ জানিয়ে ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই রাজ্যে ধর্মঘট প্রত্যাহার করার জন্য সব রাজনৈতিক দলের কাছে আর্জি জানালেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর আবেদনে অবশ্য সাড়া দিচ্ছেন না ধর্মঘটকারীরা। রাজ্যবাসীর জন্য তাই কাল, বৃহস্পতিবার ১২ ঘণ্টা সাধারণ ধর্মঘটের হয়রানি এবং অর্থনীতির জন্য আর এক প্রস্ত ক্ষতির ধাক্কা অপেক্ষা করছে!
ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি ছাঁটাই এবং খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) অনুমোদনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছে কংগ্রেস বাদে এ রাজ্যের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই। প্রধান শাসক দলের নেত্রী হিসাবে মমতা ধর্মঘটের পথে যাননি, যা করেছে বাকি দলগুলি। বিরোধী বামফ্রন্ট বৃহস্পতিবার ১২ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছে। এনডিএ-র ভারত বন্ধের সঙ্গেই পশ্চিমবঙ্গে ১০ ঘণ্টার ধর্মঘট ডেকেছে রাজ্য বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা অবশ্য তাঁর আবেদনের ‘লক্ষ্য’ হিসাবে বেছে নিয়েছেন বামেদেরই। একই প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের ঘোষণা করতে গিয়েই মঙ্গলবার তিনি বলেছেন, “সিপিএমকে বলছি, দয়া করে বন্ধ করবেন না। ওটা প্রত্যাহার করুন। আমি সব দলকেই বলছি। এই রাজ্যে বন্ধ করার কোনও মানে হয় না। যে রাজ্যটা এত বড় প্রতিবাদ করছে, সেখানে আবার বন্ধ করার তো কোনও দরকার নেই!” তৃণমূল নেত্রী বোঝাতে চেয়েছেন, ইউপিএ-র শরিক হিসাবে ‘কড়া প্রতিবাদ’ জানিয়ে তাঁরা যখন সরকার থেকে বেরিয়ে আসার মতো ‘কঠোর পদক্ষেপ’ করছেন, সেই সময় ধর্মঘট করে গরিব মানুষকে আরও বিপাকে ফেলা অর্থহীন।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এই যুক্তি মানতে নারাজ বামেরা। তাদের বক্তব্য, তৃণমূল নেত্রী কী ভাবে প্রতিবাদ জানাবেন, সেই দিকে তাকিয়ে তারা ধর্মঘট ডাকেনি। তাদের ধর্মঘট কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে। কেন্দ্রীয় সরকার যখন তেমন কোনও আশ্বাস দিচ্ছে না, তা হলে ধর্মঘট থেকে সরে আসার প্রশ্ন কোথায়? বস্তুত, বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু রাতে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্তের (তৃণমূলের) পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি, জনস্বার্থবিরোধী এই কেন্দ্রীয় নীতির বিরুদ্ধে ২০ সেপ্টেম্বর বামফ্রন্ট যে ১২ ঘণ্টার ধর্মঘট ডেকেছে, তার বিরোধিতার পথ থেকে তৃণমূল সরে আসবে। আমাদের ধর্মঘটের আহ্বান যে যুক্তিপূর্ণ, তা তৃণমূলের সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয়েছে’। কেন্দ্রের ‘জনবিরোধী নীতি’র প্রতিবাদে তাঁরা যে সাধারণ ধর্মঘটে যেতে ‘বাধ্য’ হয়েছেন, তা ‘সফল’ করতে জনসাধারণের ‘সহযোগিতা’ও চেয়েছেন বিমানবাবু।
মমতার আবেদনের আগেই এ দিন অবশ্য বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র শান্তিপূর্ণ ভাবে ধর্মঘট পালনের আর্জি জানিয়েছিলেন। সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য সূর্যবাবুর বক্তব্য, “আমরা চাই, শান্তিপূর্ণ ভাবে ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হোক। ধর্মঘট সমর্থনকারীরা কেউ নিশ্চয়ই হিংসার আশ্রয় নেবেন না। কিন্তু সরকার বা তৃণমূল জোর করে ধর্মঘট ভাঙার চেষ্টা করলে মানুষ রাস্তায় থাকবেন। কিছু ঘটলে সম্পূর্ণ দায় সরকারেরই।” ধর্মঘট করা এবং না-করা মানুষের দুই অধিকারই যাতে ‘সুরক্ষিত’ থাকে, তার জন্যও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন বিরোধী দলনেতা।
তৃণমূলের সিদ্ধান্ত জানার আগে বামফ্রন্টও এ দিন বৈঠক করে জানিয়েছিল, ‘জোর করে’ বাজার-দোকান বন্ধ করে ধর্মঘট পালন করা হবে না। মানুষের কাছে ধর্মঘট সমর্থনের জন্য প্রচার চালানো হবে। ক্ষিতি গোস্বামী, মঞ্জুকুমার মজুমদার, হাফিজ আলম সৈরানির মতো শরিক নেতাদের পাশে নিয়ে আলিমুদ্দিনে বিমানবাবু বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপন দিয়ে তেল সংস্থাগুলির যে লোকসানের কথা বলা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ডিজেলের এক পয়সাও দাম বাড়ানোর দরকার ছিল না। আর খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগে আমাদের বাংলার হাট-বাজার ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কর্মচ্যুত হবেন। তার প্রতিবাদেই ১২ ঘণ্টা হরতাল ডাকা হয়েছে।”
বিমানবাবু জানান, স্বাস্থ্য, দমকল, জল, সংবাদমাধ্যম, দুধ, পুরসভার জঞ্জাল সাফাই, বিদ্যুৎ, অ্যাম্বুল্যান্স ছাড়াও যাঁরা ষষ্ঠী পুজোর ব্রত করবেন, তাঁদের এবং হজযাত্রীদের ছাড় দেওয়া হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র কি ছাড় পাবে?
বিমানবাবুর বক্তব্য, “তথ্যপ্রযুক্তির কোনও কিছু যদি জরুরি কাজের মধ্যে পড়ে, তা হলে তা ছাড় পাবে।” ওই একই দিনে ধর্মঘট রয়েছে এসইউসি-রও। রাজ্য সরকার কড়া পদক্ষেপ করলেও সরকারি কর্মীরা ধর্মঘটে সামিল হয়ে তার প্রতিবাদ জানাবেন বলে এ দিন দাবি করেছেন এসইউসি-র রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসু।
আর এ সবের মধ্যেও তাঁর পৃথক পথ বজায় রেখেছেন প্রাক্তন মন্ত্রী, সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। মমতার ঘোষণার পরে এ দিন তাঁর প্রতিক্রিয়া, “আমি বলেছিলাম, ইউপিএ সরকার ছেড়ে এলে মমতাকে নীল সেলাম জানাব। এই যে সিদ্ধান্ত নিলেন, তার জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নীল সেলাম!” |