|
|
|
|
ঘোষণা ফেরার রাস্তা রেখেই |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা ও নয়াদিল্লি |
৭২ ঘণ্টার সময়সীমা ফুরোতে একেবারে ইউপিএ-২ ছেড়ে বেরিয়েই এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগে আরও ৭২ ঘণ্টা সময় দিলেন কংগ্রেসকে।
মঙ্গলবার রাতে টাউন হলের অ্যানেক্সে দলীয় বৈঠক সেরে মমতা ঘোষণা করলেন, শুক্রবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কাছে গিয়ে তাঁদের এক পূর্ণমন্ত্রী ও ছয় প্রতিমন্ত্রী পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। একই সঙ্গে ইউপিএ-র সঙ্গেও সম্পর্কছেদ করবেন তাঁরা। কিন্তু একই সঙ্গে এ-ও জানালেন যে, এখনও শেষরক্ষা হতে পারে, যদি তার মধ্যে কেন্দ্র (প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেস নেতৃত্ব) খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে, ডিজেলের বর্ধিত দাম তিন-চার টাকা কমায়, পরিবারপিছু ভর্তুকির সিলিন্ডারের সংখ্যা বছরে ২৪টা (পরে অবশ্য বলেন বছরে ১২টা) করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সারের দাম কমায়। মমতার কথায়, “আমরা তো অপেক্ষা করেছি। ওঁদের যথেষ্ট সময় দিয়েছি, এ বার ওঁরা বলুন।”
অর্থনীতির অঙ্ক কষে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ অবশ্য সংস্কারের পথে চলতে অনড়। ফলে মমতার দাবি মেনে নেওয়ার সম্ভাবনা যে কার্যত নেই, সে কথা বলছেন কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতারাই। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা এ-ও বলছেন যে, তৃণমূল নেত্রীকে ধরে রাখার শেষ একটা চেষ্টা চালানো হবে। কারণ, তৃণমূলের বিদায়ে সরকার পড়ে যাবে না ঠিকই, কিন্তু এই সময়ে ইউপিএ-র ভাঙনটাও মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। বস্তুত, মমতা এ দিন কংগ্রেসকে বেশ খানিকটা চমকেই দিয়েছেন। কংগ্রেস নেতাদের ধারণা ছিল, তৃণমূল মন্ত্রিসভা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও ইউপিএ ছাড়বে না। ফলে টাউন হলের ঘোষণা জানাজানি হওয়ার পরেই নড়াচড়া পড়ে গিয়েছে কংগ্রেস শিবিরে।
প্রস্থান। সাংবাদিক বৈঠক শেষ
করে বেরিয়ে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী।
ছবি: সুমন বল্লভ |
মমতা যখন দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন, তখনই অবশ্য সাত রেসকোর্স রোডে প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। সেখানে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমকেও ডেকে নেওয়া হয়। চিদম্বরম বলেন, রাজকোষের অবস্থার নিরিখে ভর্তুকি কমানো ছাড়া উপায় নেই। ফলে সংস্কারের পথে চলার সিদ্ধান্তই বহাল থাকে।
কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, ভর্তুকির সিলিন্ডারের সংখ্যা বাড়িয়ে ৮ বা ১০ করার একটা দাবি দলেই রয়েছে। (কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী নিজেই কংগ্রেস কোর গ্রুপের বৈঠকে ৮টা সিলিন্ডারে ভর্তুকি দেওয়ার কথা বলেছিলেন) টাকার দাম বাড়ায় ডিজেলের দামও এক-দেড় টাকা কমানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা কোনো মতেই সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হল, এই ‘প্রাপ্তিতে’ মমতার মন গলবে কি না। কংগ্রেস শেষ চেষ্টা চালাতে চায়। সেই কাজে এমনকী সনিয়াও নামতে পারেন।
মমতা অবশ্য এ দিন জানান, ১৪ তারিখেই সনিয়াকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, কেন্দ্র যে সব জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তাতে তৃণমূল বিচলিত। সেই সব সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সেই মোবাইল বার্তার কোনও জবাব পাননি বলেই মমতার দাবি। যদিও একই সঙ্গে তৃণমূল নেত্রীর সংযোজন, “ওঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় থাকবে।” যা আদতে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা খুলে রাখার ইঙ্গিতবাহী বলেই রাজনীতির কারবারিদের মত।
তা হলে গত ক’দিনে শুধু মন্ত্রীদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে বলে ইঙ্গিত দেওয়ার পরে হঠাৎ কেন ইউপিএ ছাড়ার চরম সিদ্ধান্ত নিতে গেলেন মমতা?
মমতার ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, তৃণমূল নেত্রী ৭২ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পরেও প্রধানমন্ত্রী কোনও বার্তা পাঠাননি। উল্টে চিদম্বরম বলেছেন, আর্থিক সংস্কারের গতি বাড়বে। ফলে মমতার ক্ষোভ বেড়েছে। তা ছাড়া, শুধু মন্ত্রীদের সরিয়ে নেওয়া হলে মমতা ‘নাটক’ করছেন, এমন অভিযোগ ওঠার সম্ভাবনা ছিল। যা হাতিয়ার করে পথে নামতে পারত সিপিএম। সেই পথ মেরে রাখলেন মমতা। পাশাপাশি কংগ্রেস যতটা ভেবেছিল তার চেয়েও বেশি ‘ধাক্কা’ দিলেন তাদের। রাজনীতির নিরিখে যাকে ‘মোক্ষম চাল’ বলেই মনে করছে তৃণমূল শিবির।
তৃণমূল সূত্রের খবর, এ দিনের বৈঠকে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও রাজ্যসভার দুই সাংসদের ‘মৃদু’ ভিন্নমত ছাড়া সকলেই দলনেত্রীর অভিপ্রায় মেনে নিয়েছেন। তিন ঘণ্টার ম্যারাথন বৈঠক শেষে মুকুল রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়ের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়-সহ রাজ্যের মন্ত্রী, সাংসদদের উপস্থিতিতে মমতা বলেছেন, “মা-মাটি-মানুষকে সেলাম জানাই। আমি দুঃখিত। আমরা ভেবেছিলাম, কেন্দ্রীয় সরকার অন্তত কিছু সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু আমাদের (সরকারে) থাকতে দেওয়া হল না। কারণ, আমরা থাকায় ওঁদের অসুবিধা হচ্ছিল। তাই ইউপিএ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি!”
|
|
বিজেপি-র মতোই এ দিন তৃণমূল নেত্রী খোলাখুলি অভিযোগ করেছেন, কয়লা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে কংগ্রেস মানুষের ‘দৃষ্টি ঘোরাতে’ই ডিজেলের দাম বাড়িয়েছে। সেই সঙ্গে তাঁর ‘হুঁশিয়ারি’, “এখন এফডিআই করছে। এর পর পেনশন বিল আসবে। পেনশনের সব টাকা শেয়ারে বাজারে খাটাবে। বলুন, এটা মেনে নেওয়া যায়!”
ইউপিএ-২ ছাড়ার সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মমতার বক্তব্য, “আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক দল ছিলাম। কিন্তু বারবার আমাদের অন্ধকারে রেখে পেট্রোপণ্যের দাম বৃদ্ধি থেকে নানা জনস্বার্থবিরোধী কাজ এই সরকার করেছে।” এমনকী, দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক হিসাবে তাঁদের কোনও ‘সম্মান’ কংগ্রেস হাইকম্যান্ড দেয়নি এবং রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের একাংশ তাঁর ‘চরিত্রহনন’ করেছেন বলেও এ দিন অভিযোগ করেন মমতা। গত লোকসভা নির্বাচনের সময় সরকারের ‘স্থায়িত্ব’ রক্ষা করার ‘প্রতিশ্রুতি’ দিয়েও যে তা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা গেল না, তার জন্য কংগ্রেসকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন মমতা। তাঁর সাফ কথা, “আমাদের সঙ্গে যারা বন্ধুত্ব রাখতে পারে না, তারা কারও সঙ্গেই রাখতে পারে না!” তাঁর আরও সংযোজন, “কংগ্রেসের খেলা আমরা জানি। মমতার সঙ্গে ঝগড়া তো মায়াবতীর সঙ্গে জোট বাঁধো! মায়াবতীর সঙ্গে ঝগড়া হলে মুলায়মের সঙ্গে। নীতীশের সঙ্গে ঝগড়া হলে লালুর সঙ্গে জোট করো!”
ইউপিএ-র থেকে সরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তৃণমূল নেত্রী জানিয়েছেন, বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘জনস্বার্থবিরোধী নীতি’র বিরুদ্ধে তাঁরা এ বার থেকে খোলাখুলি পথে নামবেন। তবে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট থেকে সরে আসা মানেই তিনি এ বার বিজেপি-র জোটের দিকে ঝুঁকে পড়বেন বলে বামেরা প্রচারে নামতে পারে। সে কথা বুঝেই সম্ভবত কৌশলে মমতার ঘোষণা, “আগামী শুক্রবার জুম্মাবার। নমাজের পর, আমাদের মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে ইস্তফা দেবেন।”
রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁদের জোট সরকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে মমতা এ দিন বলেছেন, “এটা ওঁদের (প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব) ভাবনার বিষয়।” তবে এ দিন রাতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, “আমি ইতিমধ্যেই এআইসিসি-র সম্পাদক শাকিল আহমেদের সঙ্গে কথা বলেছি। এখনই আমরা এই ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না।” |
|
|
|
|
|