পুজোর মুখে রাতভর খটাখট শব্দে মুখর হয় না তাঁতিপাড়া মাকু হাতে শাড়ি বোনার হস্তচালিত তাঁতের শব্দ। সেই শব্দ আজ করুণ-বিক্ষিপ্ত সুর কান্নার মতো শোনায় অশীতিপর তাঁত শিল্পীদের। একরাশ হতাশা এসে বুকে চেপে ধরে রাতে ঠিকমত ঘুমতে পারেন না তাঁরা। দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরের ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁতশিল্পও আজ ধুঁকছে। গত বিধানসভা ভোটের আগে গঙ্গারামপুর শহরের ভোদংপাড়া তন্তুবায় সমবায় সমিতি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বোরডাঙি সমবায় সমিতি এবং মহারাজপুর সমবায় সমিতি বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হয়ে রয়েছে তন্তুবায় সমবায় সমিতিও। এই সমস্ত সমবায়ের উপর নির্ভর করে প্রায় ৫০০ তাঁতশিল্পী এবং শ্রমিকের রুজিরুটি বজায় ছিল। শাড়ি তৈরি পিছু তাদের মজুরি মিলত ৪৫ থেকে ৮০ টাকা। একজন তাঁতশিল্পী পুজোর মরশুমে সপ্তাহে কুড়িটি শাড়ি বুনে ফেলতেন। তাঁত কর্মী দীনেশ দাস, বিশ্বনাথ সরকার, সুবোধ বসাকেরা জানান, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তাঁত সমবায়ের সঙ্গে আমরা যুক্ত। পর পর ৪টি বড় সমবায় কেন্দ্র বন্ধ হয়ে পড়ায় সমস্যায় পড়েছি। পেটের টানে অনেকেই পেশা বদলে কেউ দিনমজুর, কেউবা রিকশা চালক, ভিনরাজ্যে শ্রমিকের কাজে চলে গিয়েছেন। কুটির শিল্পে সমৃদ্ধ গঙ্গারামপুরের তাঁতের শাড়ি ঐতিহ্যে রাজ্যের নদীয়া, শান্তিপুরের মত একসময় প্রসিদ্ধ ছিল। পুজো মরশুমে তাঁদের তাঁতের শাড়ির উৎকর্ষতা ছিল নজরকাড়া। |
পুজোর তিন-চার মাস থেকেই জরি ও পাড়ের নকশা খচিত শাড়ির বায়না পেয়ে কর্মব্যস্ততা তুঙ্গে উঠত গঙ্গারামপুরের ওই পরিবারগুলির। আজ সবই প্রায় স্মৃতি। সমবায় এবং ব্যক্তি মালিকানা মিলিয়ে গঙ্গারামপুর শহর ও লাগোয়া এলাকায় ১৫ হাজার হস্তচালিত তাঁতকলের মধ্যে বর্তমানে অর্ধেকের বেশি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সরকারি অবহেলার পাশাপাশি সূতো, রঙের দাম বৃদ্ধি ছাড়াও তাঁতের শাড়ির বাজার মন্দার জেরে এই শিল্প ধুঁকছে বলে প্রবীন তাঁতশিল্পীদের অভিমত। প্রাক্তন ক্ষুদ্রকুটির শিল্পমন্ত্রী নারায়ণ বিশ্বাসের অভিযোগ, “হস্তচালিত তাঁতশিল্পকে বাঁচাতে কেন্দ্রীয় সরকারের সুস্পষ্ট কোনও নীতি ছিল না। সূতো-সহ উপকরণের দামের ওঠা নামা, মন্দা বাজার এই শিল্পকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তাছাড়া শাড়ি পিছু শ্রমিকদের মজুরি অত্যন্ত কম হওয়ায় শিল্পীরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।” বামফ্রন্ট সরকারে প্রায় ১০ বছর নারায়ণবাবু ছিলেন ক্ষুদ্র কুটির শিল্পমন্ত্রী। তথ্য বলছে, সেই আমলেই তাঁত সমবায় কেন্দ্রগুড়ি সরকারি সাহায্যে গড়ে ওঠে। তাঁতযন্ত্র থেকে শুরু করে কারখানা গড়ে দেওয়া হয়েছিল। সূতো ও রঙ সরকারি দামে সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। সমবায় কেন্দ্রগুলির মাধ্যমে বায়নার দামি শাড়ি ছাড়াও ‘জনতা’ ও ‘মালা’ দুই ধরণের সস্তার শাড়ি সরকারই কিনত। সারা বছর সচল থাকত তাঁত। ২০০৮-০৯ সাল থেকে সরকারি স্তরে এই শিল্পে উৎসাহের বরাদ্দের পরিমাণ কমে যায়। তার পরে কাজ কমতে কমতে আজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে সমবায় কেন্দ্রগুলি। বন্ধ হয়ে যায় ব্যক্তিমালিকানাধীন কারখানাগুলিও। |