শেষ পর্যন্ত বাগচিদের কাছে হেরেই গেলেন সিংহী মশাই। পর পর দু’বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। রাগে-দুঃখে দাউদাউ করে জ্বালিয়ে দিলেন কয়েকশো ঘুড়ির স্তূপ। আছড়ে ভাঙলেন রূপো বাঁধানো কাঠের লাটাই। বিরাট প্রাসাদের মত বাড়ির ছাদ থেকে নামার আগে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলে গেলেনপরের বার দেখবো!
প্রায় নব্বই বছর আগের কথা। নবদ্বীপে তখন বেশ কিছু বর্ধিষ্ণু জমিদারের বাস। পার্শ্ববর্তী বর্ধমান বা গঙ্গার পূর্বপাড়ের নদিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় তাদের ভূ-সম্পত্তি থাকলেও বসবাসের জন্য নবদ্বীপকেই তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন। আর নানা বিষয়ে তাদের মধ্যে চলত রেষারেষি। গাজনের সঙ থেকে দুর্গাপুজো। ঘুড়ি ওড়ানো থেকে কীর্তনের আসর। কে কাকে ছাপিয়ে যেতে পারেন!
এদের মধ্যে ব্যয়ের ব্যাপারে সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন শিবচন্দ্র সিংহ। লোকে বলত দানবীর শিবু সিংহী। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শিবচন্দ্র ঘুড়ি ওড়াতেন। তাঁর নিয়ম ছিল প্যাঁচ খেতে গিয়ে তার কেটে যাওয়া ঘুড়ি যে ধরে আনবে তাকে ঘুড়ি পিছু ১ টাকা করে দেবেন তিনি।
এজন্য বিশ্বকর্মা পুজোর দিন সকাল থেকে বহু লোক তার বাড়ির চারপাশে ভিড় জমাতো। তাঁর ঘুড়ি ভোকাট্টা হলেই দৌড় শুরু করতো ছেলে-বুড়োর দল। তারপর কাটা ঘুড়ি ধরে নিতে পারলেই নগদ ১ টাকা। সারা দিনে শিবচন্দ্র কয়েকশো ঘুড়ি ওড়াতেন।
কিন্তু সেবার ছবিটা বদলে গেল। শিবচন্দ্রের ঘুড়ি ধরার জন্য ছেলে-ছোকরার দল সেভাবে ছুটছে কই! তাদের লক্ষ অন্য প্রান্তের রায়বাহাদুর পূর্ণচন্দ্র বাগচির বাড়ির ঘুড়ি। সে ঘুড়ি কাটলেই পিলপিল করে লোক ছুটছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বাগচি বাড়ির ঘুড়ির গায়ে ১০ টাকার নোট আটকানো আছে। যে ঘুড়ি ধরবে ওই দশ টাকা তার নগদ প্রাপ্তি। সেই বছর ১ টাকার জন্য আর কেউ সিংহী মশাই-এর ঘুড়ি ধরতে ছোটেনি।
পরের বছর শিবচন্দ্র কি প্রতিশোধ নিয়েছিলেনতা জানা যায়নি। কেউ কেউ বলেন, তিনি নাকি পরের বছর ঘুড়ির কাঠামো তৈরি করার জন্য বাঁশের বদলে সরু রূপোর তার ব্যবহার করেছিলেন। স্থানীয় ইতিহাসে অবশ্য তার কোনও প্রমাণ নেই।
ঘুড়ি নিয়ে এমন নানা গল্প এখনও শোনা যায় পুরনো নবদ্বীপকে ঘিরে। তবে হঠাৎ করে এবারে বিশ্বকর্মা পুজোয় আবার ঘুড়ি ওড়ানোর হিড়িক দেখে সে কথা মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক প্রবীণ মানুষেরই। প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ঘুড়ি ওড়ানো হঠাৎ করে এ বছরে কেন এমন তেড়েফুঁড়ে উঠল, তার ব্যাখ্যা অবশ্য কেউ দিতে পারেননি। শহরের গত ১৫ দিনে ৪০টি অস্থায়ী ঘুড়ির দোকান গজিয়ে উঠেছে। অথচ রবিবার দুপুরের পর থেকেই কার্যত ঘুড়ি-লাটাইয়ের হাহাকার পড়ে গিয়েছে। সোমবার দুপুর ২টো। ছ’বছরের ভাইপো তপোব্রত’র হাত ধরে পাগলের মত ঘুড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছেন বর্ধমান উইমেন্স কলেজের সংস্কৃতের অধ্যাপক বাসুদেব ভট্টাচার্য। বাসুদেববাবু বলেন, “এবারে যে কি হয়েছে বুঝতে পারছি না। ঘুড়ি নিয়ে সকলে যেন পাগল গিয়েছে।” তিনি বলেন, “ছোটবেলার মত আবার সেই উন্মাদনা এবার আচমকা ফিরে এসেছে। আমিও দীর্ঘ অনেক দিন পরে ঘুড়ি ওড়াবো।”
দীর্ঘ দিনের ঘুড়ি ব্যবসায়ী নারু দাস বলেন, “এবার বৈশাখ মাস থেকে ঘুড়ির বাজার চলছে। গত কাল সন্ধ্যার পরে ঘুড়ি দিতে পারিনি। দোকানে রাতে হামলা চালায় এক দল ছেলে। আসলে ঘুড়ির বাজার এমন চাঙ্গা হবে বুঝতে পারিনি।” প্লাস্টিকের ঘুড়ি ১ টাকা থেকে তিন টাকায়, কাগজের ঘুড়ি ২ টাকা থেকে ৭ টাকায় বিকিয়েছে। ময়ূরপঙ্খী, শতরঞ্চি, হরহরিয়া, তিলককাটিয়া, মুখপোড়া, কালো টেক্কাহাজারো নামের ঘুড়ির পাশাপাশি এবার বাজারে এক সঙ্গে ডিজাইনার ঘুড়ি, নানা ফুল আর পাখির আকারের ঘুড়ির চাহিদাও আকাশছোঁয়া।
সব মিলিয়ে সোমবারের শহরে ঘুড়ির দখলে ছিল আকাশ। প্রতি ছাদে ছেলে-ছোকরার দল। আর তাদের সমহেত চিৎকারভোকাট্টা! |