ভারত মহাসাগরকে বিপরীতে রেখে তাজ সমুদ্র হোটেলের লবি থেকে টিম ইন্ডিয়া বার হল দুপুর সাড়ে বারোটা। বেশ হেলতে-দুলতেই এক-এক জন বাসে উঠছিলেন। বার্থডে বয় রবিচন্দ্রন অশ্বিনের জন্য কেক কেটে নেওয়ার যথেষ্ট সময় তার মধ্যে ছিল। এক খেলোয়াড়ের মুখে শুনলাম কেক কাটা হবে রাতে। ছোট পার্টিও হতে পারে।
রাতের প্রেমদাসা স্টেডিয়ামে ম্যাচ লিখতে বসে আন্দাজ করার চেষ্টা করছি পার্টিটা ভন্ড হয়ে গেল কি না? আন্দাজ করার চেষ্টা করছি ভারত-পাক ম্যাচের দিন টিমমেটের জন্য কেক কাটা রাত অবধি মুলতবি রাখা আর তখন পার্টিকোথাও আত্মতুষ্টির গন্ধ লুকিয়ে ছিল কি না? ইদানীং যখন যেখানে দেখা হয়েছে ধোনির ভারত পাকিস্তানকে হারিয়েছে। মধ্যিখানে ২০০৯-এর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বাদ দিলে কোথাও তো হারের ইতিহাস নেই। জন্মদিন যে নীরবতা পালনের রাত হয়ে দেখা দিতে পারে, হয়তো ভাবাই হয়নি।
আর যতই ওয়ার্ম আপ ম্যাচের শেষ ওভারে ৫ বল বাকি থাকতে পাঁচ উইকেটে হার হোক। হারের ধরনটা ভীষণ পরিচিত। অধুনা যিনি পাক বোর্ডের সর্বময় কর্তা হয়েছেন সেই জাভেদ মিয়াঁদাদের সময়কার। পাকিস্তান দারুণ সঙ্কটে থাকবে, মনে হবে অবধারিত হারছে, প্রেসবক্স ভারত জিতছে ধরে নিয়ে ম্যাচ রিপোর্টও লেখা শুরু করে দেবে। তার পর আকস্মিক এক ব্যক্তি আবির্ভূত হবে বাইশ গজে। আপাত অসম্ভব টার্গেটের পিছনে সোমবারের কামরান আকমলের মতো (৫০ বলে অপরাজিত ৯২) সে দৌড় শুরু করবে। আর একটা সময় দেখা যাবে মিডিয়া বক্স ব্যাকুল ভাবে ইন্ট্রো বদলাচ্ছে। কারণ, সে যে হারা ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছে। |
সকালে টসের সময় মনে হচ্ছিল ইডেনে স্পোর্টিং ইউনিয়ন-কালীঘাট ম্যাচ দেখতে এসেছি। ভুলইডেনে কর্মকর্তা-দর্শক মিলিত সংখ্যাটা অন্তত মিডিয়ার নামমাত্র উপস্থিতির চেয়ে বেশি থাকে। অথচ প্রেমদাসায় কী অদ্ভুত বৈপরীত্য। মিডিয়ায় থিকথিক করছে ভিড় আর গ্যালারি ফাঁকা। মাঠে ঢোকার মুখে দেখে এসেছি সচিন তেন্ডুলকরের আখ্যা দেওয়া তাঁর সবচেয়ে বড় সমর্থক সুধীর গৌতম সঙ্গে এক পাকিস্তানিকে নিয়ে দু’দেশের পতাকা সমেত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। কিন্তু আজ সেই দাঁড়ানোর বডি ল্যাঙ্গোয়েজে যত না উত্তেজিত সমর্থন, তার চেয়ে বেশি টিভিকে ছবি দেওয়া। সাদা বাংলায় ডিজাইনার প্রচারের ফন্দি। ম্যাচ রেফারি নেই। দুই আম্পায়ার গেলেন টসে অধিনায়কদের সঙ্গে। ধোনি জিতলেন কিন্তু বরাদ্দ হাততালির প্রশ্ন নেই। লোকই তো নেই। চেঁচাবে কে! ভারত-পাক ক্রিকেট খেলছে অথচ উত্তেজনা নেই, এ তো শাদির মহাভোজে নুন-ছাড়া রান্নার মতো। ইএসপিএন ক্যামেরাম্যানরা তখন বুঝে উঠতে পারছেন না খালি গ্যালারি বুঝতে না দিয়ে কী ভাবে শট নেবেন! বিনা টিকিটের বিনোদন, তা-ও কি না লোক নেই।
ভিড়টা বেড়ে ক্রমশ হাজার চারে পৌঁছে গেল। চিৎকারটাও ফেরত চলে এল ভারতীয় ইনিংসের মাঝপথেই। ম্যাচের শেষ দু’ওভার পাকিস্তানি রিজার্ভরা যে ভাবে কোচ হোয়াটমোরের পরামর্শ বা চিরকুট নিয়ে মাঠে দৌড়তে দৌড়তে ঢুকছিলেন। ডাগআউটে যেমন নার্ভাস, অস্থির আর ক্রমেই সুখী হয়ে পড়ল টিম পাকিস্তান। তা থেকে বোঝা গেল, আর যা-ই হোক ম্যাচটা ভারত-পাকিস্তানই ছিল! দৃষ্টিহীনরা তাকে ওয়ার্ম আপ ধরেছে।
ধোনির সোমবারের প্রেমদাসা থেকে পাওনা ছিল দ্বিমুখী।
ক) এগারো জন সহ বোলার-ব্যাটসম্যানের চূড়ান্ত কম্বিনেশনটা সেট করে ফেলা।
খ) বিশ্বকাপের প্রাথমিক দিকটার জন্য ম্যাচ জিতে ছন্দটা আগাম বানিয়ে রাখা। ‘খ’ সফল হলে অনিবার্য ‘গ’-ও এসে পড়ে। পাকিস্তানকে মর্যাদাযুদ্ধে সেই বিঁধেই রাখা।
আর তিনটে লক্ষ্যই কিনা বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে কেটে যাওয়া ঘুড়িগুলোর মতা ভোকাট্টা হয়ে গিয়েছে!
কামরান আকমলের ১৮৪ স্ট্রাইক রেট তুলে দেওয়া ধোনির ভারতকে বিকট এবং ক্যাটকেটে এক প্রশ্নের মুখোমুখি করছে। তিন পেসার খেলাবে না দুই স্পিনার? বারো জনের আজকের টিম থেকে বোলার কমবে না ব্যাটসম্যান? রোহিত শর্মা বসার লোভনীয় ক্যান্ডিডেট হতে পারতেন। প্রবলেম হল এ দিন ৪০ বলে ৫৬ করে দিয়েছেন। জাহিরকে বসানো কঠিন। তিনিই পেস বোলিং বিভাগের নেতা। ইরফান ৪ ওভারে ৪১ দিয়েছেন। বালাজিও ওভারপিছু ১০ রান করে। ডেথ-এ তাঁর ইয়র্কার-টিয়র্কার কাজ করেনি। ব্যাটসম্যান ফলো থ্রু-র আগে থেকে অফস্টাম্পের বাইরে সরে গিয়ে মিড উইকেট দিয়ে স্কুপ করে দিয়েছে। এমনিতেও টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বের প্রথম কুড়ি জনের র্যাঙ্কিংয়ে কোনও ভারতীয় বোলার নেই। অশোক দিন্দা ছাড়া এমন একজনও নেই যে ঘণ্টায় একশো চল্লিশ কিমির বেশি গতিতে বল করতে পারে।
প্রেমদাসা অন্তত আজকে যেমন চটচটে, সুইডিশ ক্লে কোর্ট সদৃশ ছিল তাতে গতিতে লাভ হবে বলে মনে হয় না। তাই মনোজ তিওয়ারির মতো দিন্দাকেও না সেই বসে থাকতে হয় টুর্নামেন্টের শুরুর দিকটা। কিন্তু হরভজন? তাঁকে নিয়ে কী করা হবে? এ দিন বারো জন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলল বলে ভাজ্জিকে বল করানো গিয়েছিল। অথচ ৪ ওভারে যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী অশ্বিন ৪-২৩ সেখানে ভাজ্জি ০-৪০। এমনিতে অশ্বিন-ভাজ্জি সম্পর্ক সেই সঞ্জয় লীলা বনশালীর ‘দেবদাস’ তৈরি করার কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। দুই নায়িকা ছিলেন মাধুরী আর ঐশ্বর্য। জনশ্রুতি একজন ফ্লোরে দু’ঘণ্টা দেরি করে পৌঁছলে পরের দিন আর একজনের মেকআপ করতে লেগে যেত বাড়তি তিন ঘণ্টা! দু’জনে কথা? প্রায় হত না বললেই চলে।
|
আজ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে
শ্রীলঙ্কা বনাম জিম্বাবোয়ে (সন্ধে ৭-৩০) |
|
সংক্ষিপ্ত স্কোর: ভারত ১৮৫-৩ (বিরাট কোহলি ৪৭ বলে ৭৫, রোহিত শর্মা ৪০ বলে ৫৬, সইদ আজমল ২-২২, উমর গুল ১-৩১)।
পাকিস্তান ১৮৬-৫ (কামরান আকমল ৫০ বলে ৯২, মহম্মদ হাফিজ ২৯ বলে ৩৮, শোয়েব মালিক ১৮ বলে ৩৭, রবিচন্দ্রন অশ্বিন ৪-২৩)। |