সওদার রেল-গাড়ি
রাস্তায় ‘দোকান’ খুলে ট্রেনের খাবার আধা দামে
জ্যাম-জেলি, বিস্কুট, মাখন, ঠান্ডা পানীয় থেকে জলের বোতল। প্রতিটার উপরে ছাপ্পা মারা ‘ফর রেলওয়ে ওনলি।’
কিন্তু সে ছাপ্পার ধার ধারে কে?
অতএব শুধুমাত্র রেলযাত্রীদের জন্য ‘নির্দিষ্ট’ খাদ্য-পানীয় দেদার বিকোচ্ছে হাওড়া স্টেশনের বাইরের ‘খোলাবাজারে।’ ঢেলে বিক্রি যাকে বলে! লুকোছাপা তো নেই-ই, বরং রেলযাত্রীদের খাবার-দাবার জোগানোর সরকারি বরাত যে সংস্থার হাতে, খোদ সেই ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কেটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন (আইআরসিটিসি)-এরই গাড়িতে চাপিয়ে এনে ‘চালান’ তুলে দেওয়া হচ্ছে খরিদ্দারদের হাতে।
দাম? বিস্তর কম, অনেক ক্ষেত্রে তো ছাপা দরের অর্ধেক!
সুতরাং চাহিদারও অন্ত নেই। সস্তার সওদা ঘরে তুলে আসল দামে বেচলেই তো মোটা লাভ!
ডালা খুলে দোকান তৈরি।
সেই দাঁও মারার মওকা হাত গলে যেতে দিতে স্বভাবতই রাজি নন আশপাশের বহু দোকানদার-ব্যবসায়ী। সোমবার দুপুরেও মুখরাম কানোরিয়া রোডে আইআরসিটিসি’র সওদা-গাড়ির অপেক্ষায় উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা। রোজকার মতো। অপেক্ষার অবসান বেলা ঠিক সাড়ে বারোটায়। হাওড়া স্টেশন লাগোয়া সব্জি-বাজারের পাশের রাস্তাটিতে ‘রেলের মাল’ নিয়ে গাড়ি ঢুকল। সাদা রঙের ভ্যান (নম্বর: ডব্লিউবি/২৫বি ৭০০৯)। বনেটে লেখা ‘ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কেটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন, ইন্ডিয়ান রেলওয়ে।’ নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়ানোর পরে ভ্যানের পিছনের ডালা খুলে দিল এক তরুণ। ভিতরে থরে থরে ‘পসরা’ সাজানো জ্যাম-জেলি-বিস্কুট-মাখন-পানীয়। সব ‘ফর রেলওয়ে ওনলি।’
‘দোকান’ খুলেছে দেখে খদ্দেরের দল এগিয়ে এলেন। ভিড় জমালেন চারপাশে। এক-এক জন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জানিয়ে দিলেন, কার কোন জিনিস কতটা দরকার। সেই মতো তরুণটি মাল তুলে দিলেন তাঁদের হাতে। সব নগদে কারবার, ধার-বাকির ব্যাপার নেই। রসিদেরও বালাই নেই।
পসরা নিয়ে হাজির হল আইআরসিটিসি-র ভ্যান।
ট্রেনের যাত্রীদের ন্যায্য দামে জোগানোর উদ্দেশ্যে ওই সব খাবার-পানীয় প্রস্তুতকারী বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে রীতিমতো টেন্ডার ডেকে কিনে থাকেন রেল-কর্তৃপক্ষ। পরে তাতে রেলের ছাপ (ফর রেলওয়ে ওনলি) দেওয়া স্টিকার লাগানো হয়। অথচ বেশ ক’বছর ধরে যাত্রীদের হাতে পৌঁছানোর বদলে জিনিসগুলোর বড় একটা অংশ এ ভাবে বেহাত হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। স্থানীয় সূত্রের খবর: হাওড়া স্টেশনের ঢিল ছোড়া দূরত্বে ওই মুখরাম কানোরিয়া রোডেরই চারটে গুদাম এই মুহূর্তে ‘রেলের মালের’ আড়ত। কিছু চলে যায় হাওড়া বাসস্ট্যান্ডের পাশে গাঁজাকুটিরের ভিতরে।
আইআরসিটিসি’র গাড়িতে সওয়ার হয়ে রেলের জিনিস বাজারে বিকোচ্ছে, এ দৃশ্য নিঃসন্দেহে ধাক্কা খাওয়ার মতো। কিন্তু ‘ফর রেলওয়ে ওনলি’ মার্কা দেওয়া জিনিস বাইরে বেরোয় কী করে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইআরসিটিসি’র এক প্রাক্তন কর্মী জানাচ্ছেন, মূলত দু’ভাবে এই দুর্নীতি হয়। দূরপাল্লার ট্রেনযাত্রীদের জন্য হাওড়া এবং বড় বড় স্টেশনের ‘বেস কিচেন’-সহ বিভিন্ন যে সব জায়গায় খাদ্য-পানীয় আগাম মজুত রাখা হয়, সেখান থেকেই তার একটা অংশ বাইরে চলে যায়। পরিবর্তে এনে রাখা হয় নিম্নমানের জিনিস, যেগুলোয় রেলের ছাপ মারতেও ভুল হয় না। পাশাপাশি স্টেশনের গুদাম থেকেও অনেক মাল পাচার হয়। সংগঠিত চক্র ছাড়া এ কাজ সম্ভব নয় বলেই রেল ও ব্যবসায়ীমহল-সূত্রের দাবি।
রেলের ছাপ মারা পণ্যসম্ভার।
অনিয়ম রুখতে রেল-কর্তৃপক্ষ কী করছেন? আইআরসিটিসি-কর্তৃপক্ষেরই বা বক্তব্য কী? দু’পক্ষ আপাতত একে অপরের ঘাড়ে দায় ঠেলতে ব্যস্ত। হাওড়া স্টেশনে আইআরসিটিসি-র অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার (ফিনান্স)) বরুণকুমার চাকী বলেন, “আমরা এখন শুধু রাজধানী এক্সপ্রেস আর দুরন্ত এক্সপ্রেসে যাত্রীদের খাবার দিই। ওই খাবারের সব প্যাকেটে আইআরসিটিসি-র ছাপ মারা থাকে। এখন বেশির ভাগ ট্রেনে যাত্রীদের কাছে রেলই সরাসরি খাবার বিক্রি করে। সেই সব খাদ্য-পানীয়ের প্যাকেটে রেলের ছাপ থাকে, আমাদের নয়।”
এবং রেলের ছাপ মারা ওই সব খাদ্য-পানীয়ই খোলাবাজারে অবাধে বিকোচ্ছে বলে বরুণবাবুর দাবি। কিন্তু তা আইআরসিটিসি’র গাড়ি করে বাজারে আনা হচ্ছে যে?
বরুণবাবুর জবাব, “ব্যাপারটা আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব।” অন্য দিকে হাওড়ার ডিভিশন্যাল রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) অনির্বাণ দত্ত ঘটনার পুরো দায় চাপিয়েছেন আইআরসিটিসি’রই উপরে। “রেলের খাবার মূলত আইআরসিটিসি বিক্রি করে। সেই খাবারের প্যাকেটে রেলের ছাপ ওরাও মারতে পারে।” বলছেন তিনি। যা-ই হোক না কেন, বিষয়টি যে ডিআরএমের দেখার এক্তিয়ারে নয়, তা-ও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন।
তা হলে দেখার দায়িত্ব কার? রেল-রক্ষীদের কোনও ভূমিকা নেই? হাওড়া আরপিএফের সিনিয়র কমান্ড্যান্ট অ্যারোমা সিংহঠাকুরের ব্যাখ্যা, “রেলের খাবার বাইরে বেরিয়ে বিক্রি হয়ে গেলেও তা আরপিএফের দেখার কথা নয়। এটা রেলের বাণিজ্যিক (কমার্শিয়াল) বিভাগের আওতায়।”
রেলের বাণিজ্যিক বিভাগের কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে চাননি। তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন জনসংযোগ বিভাগকে। আর পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ অফিসার সমীর গোস্বামী বলছেন, “এমন অভিযোগ আগে পাইনি! এ বার নিশ্চয় তদন্ত হবে।” তদন্ত কবে হবে, কিংবা তাতে কী বেরোবে, তা বলা সময়সাপেক্ষ। এখন অন্তত জলের দরে ‘রেলের মাল’ পেয়ে ক্রেতার দল বিলক্ষণ সন্তুষ্ট।
এ দিন যেমন সওদা সেরে ফেরার পথে হাওড়া স্টেশন চত্বর ও গোলাবাড়ির একাধিক দোকানদার জানিয়ে গেলেন, ‘রেলের গাড়ি’ কখন আসবে, সে খবর তাঁরা ঠিক সময়ে পেয়ে যান। সময়মতো চলেও আসেন। এমনটাই তো চলে আসছে!

ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.