জিন্সের প্যান্ট এবং টি-শার্ট পরে রোজই প্রায় পাড়ায় আড্ডা মারেন। গরমে চোখে সানগ্লাস। শহরের বিভিন্ন মলে ঘুরে বন্ধুদের সঙ্গে শপিং করতে ভালবাসেন।
বছর তিরিশের ওই যুবকের নাম প্রেমময় চক্রবর্তী। পেশায় পুরোহিত।
সোমশুভ্র চক্রবর্তী। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক। এখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্র। পাশ করার পরে পারিবারিক পেশা পৌরোহিত্যকেই জীবিকা করতে চান।
অপুর পাঁচালি কি তবে বদলে গেল? বিভূতিভূষণের উপন্যাসে ‘পুরুতগিরি’ করবে না বলেই রুখে দাঁড়িয়েছিল অপু। গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছিল। এ কালের ‘অপু’রা কিন্তু অনেকে লেখাপড়া শিখেও ফিরে যেতে চাইছেন পারিবারিক পেশার আশ্রয়ে।
কেন? শহর এবং শহরতলিতে বাড়ি-ঘর, ফ্ল্যাটের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সেই তুলনায় পুরোহিতের সংখ্যা পড়তির দিকে। ফলে যোগ্য পুরোহিতের চাহিদা বাড়ছে। চাকরির বাজারে মন্দার এই সময়ে পৌরোহিত্যকেই লাভজনক পেশা বলে মনে করছেন শিক্ষিত যুবকদের একাংশও। পলাশ চট্টোপাধ্যায় যেমন সরাসরি বলছেন, “শহরাঞ্চলের বাড়িতে পুরোহিত হিসেবে কাজ করলে যে টাকা আয় হয়, তা অন্য অনেক তথাকথিত সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার চাকরির চাইতে বেশি।”
বেশ কয়েক জন যুবক যত্ন করে পৌরোহিত্যের পাঠ নিয়ে পুরোহিত হিসেবে বিদেশেও পাড়ি দিয়েছেন। তিরিশ বছর বয়সী সমীরণ চক্রবর্তী গত দু’বছর ধরে পুরোহিত হিসেবে মার্কিন মুলুকের একটি মন্দিরে কাজ করছেন। তিনি জানান, “প্রবাসী ভারতীয়রা যে সব জায়গায় রয়েছেন, সেখানে পুরোহিতের চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন যায়গায় ভারতীয় মন্দিরগুলিতে সংস্কৃত জানা পুরোহিতের চাহিদা যথেষ্ট।”
প্রেমময়ের বাড়ি যেমন বাড়ি বিরাটির প্রতাপগড়ে। প্রায়ই তাঁকে ধুতি পরে আলোয়ান গায়ে ঘণ্টা নিয়ে পাড়ার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে দ্রুত চলাচল করতে দেখা যায়। সোমশুভ্র খোলাখুলি বলছেন, পৌরোহিত্য তাঁদের পারিবারিক পেশা। তিনিও সেই ধারাই বজায় রাখতে চান। হাওড়ার পাঁচলার বাসিন্দা, যুবক চন্দন ঘোষালের মতও তাই। “আমাদের পরিবারের অন্তত ৩০০ যজমান রয়েছেন। আমার অন্য কোনও চাকরির প্রয়োজন হয় না। আর্থিক দিক তো বটেই, ভারতীয় পরম্পরার সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারারও একটা আলাদা গুরুত্ব আছে।” পলাশের ক্ষেত্রে পৌরোহিত্য পারিবারিক পরম্পরাও নয়, তিনি নিজের তাগিদেই পুজোর কাজ শিখেছেন। এমনিতে রবীন্দ্র ভারতী থেকে এম-মিউজ করেছেন। কিন্তু গানকে পেশা না-করে সংস্কৃত শিখে পৌরোহিত্য শুরু করেছেন। আর্থিক নিরাপত্তাই তার একমাত্র কারণ, জানালেন পলাশ।
অথচ শিক্ষিত ব্রাহ্মণ সন্তানেরা সাধারণত পৌরোহিত্যকে পেশা হিসেবে না নেওয়াটাই দস্তুর। বিশিষ্ট সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ, বন্ধু গৌরব স্বীকার করছেন, “এ কালে পৌরোহিত্যের কাজ যাঁরা করেন তাঁদের ৯৯ শতাংশই ভাল করে সংস্কৃত পড়তে জানেন না। যাঁদের লেখাপড়া তেমন হয়নি, তাঁরাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও পৌরোহিত্যকে জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।” তবে এই ছবিটা ক্রমশ বদলাচ্ছে। পুরোহিতের পেশায় প্রতিযোগিতা কম, তাই বেকারত্বের মোকাবিলা করতে গত কয়েক বছরে বহু ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে এই পেশাকে বেছে নিচ্ছেন। সংস্কৃতজ্ঞ প্রণব নন্দা বললেন, “পৌরোহিত্যকে পেশা করার তাগিদে অনেকে সংস্কৃত শিখছেন। এতে যেমন যুবকরা শুদ্ধ ভাবে পুজো করে আয় করছেন, পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষারও প্রসার ঘটছে।” |